পলাশ খাঁ, গোয়ালতোড় :- শীতকাল মানেই খেজুর গুড়। আর মকর সংক্রান্তি মানে আপামর বাঙালীর খেজুর গুড় চাই চাই। তবে এবার সেই স্বাদ পুরণ করতে হাপিত্যেশ করতে হচ্ছে আপামর বাঙালী কে। কারণ কনকনে ঠান্ডা যত বেশী হবে খেজুর গাছ থেকে রস বেশী পাওয় এবং স্বাদে এবং গন্ধেও হয়ে উঠে অতুলনীয়। কিন্তু এবার মকরসংক্রান্তির আগেই শীত ফুসমন্তর হয়ে গেছে৷ ফলে একদিকে যেমন গাছ থেকে রস বেশী পরিমানে পাওয়া যাচ্ছে না ঠিক তেমনই যে টুকু রস পাওয়া যাচ্ছে তাতে উন্নত মানের গুড় তৈরি হচ্ছে না৷ ফলে মকরের আগেই পুরো জঙ্গলমহল জুড়ে নলেন গুড়ের হাহাকার পড়ে গিয়েছে। আর এতে করেই একদিকে যেমন ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে শিউলিদের, তেমনই মকরের আগে নলেন গুড় না পেয়ে হাপিত্যেশ করছে স্থানীয়রা।
বাকুড়ার জয়পুর থানার বৈতল গ্রামের এগরামুল মল্লিক দীর্ঘ বারো বছর ধরে গোয়ালতোড়ের কিয়ামাচাতে খেজুর গুড় তৈরি করেন। কিয়ামাচা ছাড়াও গোয়ালতোড় ও শালবনীর আরো তিন জায়গায় মহল করে গুড় তৈরি করেন। তিনি জানান, “দীর্ঘ বারো বছর ধরে এই এলাকায় গুড় তৈরি করছি, প্রতি বছরই মোটামুটি লাভ করে বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু এবছর লাভ তো দুরের কথা, মহল করতে যে টাকা খরচ হয়েছে গুড় বিক্রি করে সে টাকা তোলায় দায়”। কারন তিনি জানান, একটি মহল তৈরি করার জন্য নতুন হাড়ি কেনা, হাতিয়ার বানানো, খাওয়া দাওয়া মিলিয়ে এক সিজিনে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। তার উপর গাছ মালিকদের গাছ পিছু ৪ কেজি করে গুড় দিতে হয়। ফলে চারটি মহলের যে খরচ হয়েছে তাতে ক্ষতি ছাড়া উপায় নেই। একই বক্তব্য গোয়ালতোড়ের পড়াকানালীর শিউলি অনিল বাস্কে, শালবনীর বেলবনীর ঝটু সরেন, গুলজার আলি খান প্রমুখরা। সকলেরই বক্তব্য ঠিকঠাক শীত না পড়ায় যেমন গাছ থেকে রস ঠিকঠাক পাওয়া যাচ্ছে না। আর যে টুকুও বা পাওয়া যাচ্ছে তার থেকে উন্নত মানের গুড় তৈরি হচ্ছেও না।
গোয়ালতোড়ের পড়াকালীন গ্রামের বছর ৪০ এর অনীল বাস্কে পেশায় বাড়ই এর কাজ কারেন। বছর তিনেক ধরে এই শীতে খেজুর গাছ ভাগে নিয়ে খেজুর গুড় তৈরি করে বিক্রি করেন৷
এই বছর অনীল বাবু গাছ প্রতি চার কেজি গুড়ের চুক্তিতে ১৩০ টি গাছ ভাড়া নিয়ে গুড় তৈরি করছেন। অনিল ছাড়াও গোয়ালতোড়ের বিভিন্ন এলাকায় আরো কুড়ি পঁচিশ জনের মতো মহলদার গুড় বানাচ্ছেন। সকলেই এই খামখেয়ালি শীতের কারনে ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
গোয়ালতোড়ের কিয়ামাচার দীপেন সাহা, সজল মন্ডলরা আজ দু দিন দিন ধরে সকাল হলেই মহল আসছেন আর ফিরে যাচ্ছেন গুড় না থাকার জন্য। সজল বাবুর বক্তব্য, “প্রতি বছরই আত্মীয় বাড়ি পাঠানোর জন্য আমার প্রায় ২০ কেজি গুড়ের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু এবার পাঠাতে পারলাম না”। একই বক্তব্য দীপেন সাহা, রাহুল অধিকারী, ধীরেন খা প্রমুখদের।
গুড়ের এই অপ্রতুলতার কারন হিসেবে এগরামুল, অনিল, গুলজাররা জানান অন্যান্য বছর যেখানে প্রতিদিন এক টিন অর্থাৎ ২৫ কেজি থেকে ৩০ কেজি গুড় হয়। সেখানে এবার দশ বারো কেজির বেশী গুড় হচ্ছে না৷ কিন্তু এক একজন এসে পাঁচ কেজি ১০ কেজি গুড় চান। ফলে দিতে পারছি না। তার উপর মিষ্টি দোকানেও আমাদের গুড় দিতে হয়। ফলে অনেকেই গুড় কিনতে এসে খালি হাতেই ফিরে যাচ্ছে। গোয়ালতোড় এলাকার এক গুড় ব্যাবসায়ী উত্তম মাহাতো দীর্ঘ প্রায় কুড়ি বছর ধরে খেজুর গুড়ের ব্যাবসা করছেন। তিনি গোয়ালতোড়, শালবনী প্রভৃতি এলাকার মহল থেকে গুড় কিনে মেদিনীপুর, ঘাটাল সহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে এই ব্যাবসা করেন। তিনি জানান গত বছর প্রায় ৫-৬ কুইন্টাল খেজুর গুড় বিক্রি করেছি। আরও অন্তত ২ কুইন্টাল গুড় বিক্রি করতে পারতাম কিন্তু আর গুড় নেই।