Homeএখন খবরচোলাইয়ের চক্র ভেঙে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সম্মানিত ঘাটালের 'দুর্গা'

চোলাইয়ের চক্র ভেঙে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সম্মানিত ঘাটালের ‘দুর্গা’

নিজস্ব সংবাদদাতা: কত মৃত্যু আসে মানু্ষের জীবনে! যে মৃত্যু মানুষকে মৃত্যু কাতরতায় ঠেলে দেয়। প্রিয়জনের মৃত্যুশোক আচ্ছন্ন করে জীবন কিন্তু সেই আচ্ছন্নতা স্থায়ী হলে জীবন চলেনা তাই একদিন শোক ভুলে মানুষ ফের উঠে দাঁড়ায়। ফেলে আসে শোক। যা গেছে , তা গেছে বলে নতুন করে বাঁচা। কিন্তু সব্বাই তা হয়না, কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, কেন গেছে ? যাওয়া জরুরি ছিল কী ? এমনই এক চরিত্রের নাম, দুর্গা। না নাটক , যাত্রা, সিরিয়াল, সিনেমা নয়, বাস্তবের দুর্গা, রক্তে মাংসের। পশ্চিমমেদিনীপুর জেলার প্রান্তিক শহর ঘাটালের আরও প্রান্তিক গ্রামের এক গৃহবধূর নাম দুর্গা, দুর্গা মালিক।

শুক্রবার, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্কালে সেই দুর্গাকে সম্বর্ধিত করেছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নারী ও শিশুকল্যান এবং সমাজ কল্যান দপ্তর। সল্টলেকের রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনে এই সম্মান জ্ঞাপন করা হয় মাননীয় মন্ত্রী শশী পাঁজা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে। তুলে দেওয়া হয় স্মারক, সাম্মানিক ও মানপত্র। প্রতিবছরই রাজ্য সরকার নারী প্রতিভা, কর্মকাণ্ড, সংগ্রামী জীবন ইত্যাদি নানা বিষয়ের স্বীকৃতি স্বরূপ এই সম্বর্ধনা প্রদান করে থাকেন, যা এবার পেয়েছেন দুর্গা। কিন্তু কেন ? বছর পঞ্চাশের দুর্গার বাড়ি ঘাটাল শহর থেকে ৭কিলোমিটার দুরে গোপমহল গ্রামের মালিকপাড়ায়। একসময় শুধু ঘাটালই নয়, সমগ্র ঘাটাল মহকুমা সহ পাশের জেলা হুগলি কিংবা পূর্ব মেদিনীপুরেও চোলাই মদ সরবরাহ করত এই মালিকপাড়া। গ্যালন গ্যালন চোলাইয়ের ডিপো এই মালিক পাড়ার চোলাই চক্র নিয়ন্ত্রনে হিমসিম খেয়েছে পুলিশ আর আবগারি দপ্তর।

প্রায় নিরক্ষর দুর্গা যেদিন নবপরিনীতা হয়ে স্বামীর সংসারে এসেছিলেন সেদিন এই চোলাই মাহাত্ম্য বুঝতে পারেননি। মুখ বুঝে সংসার করেছেন আর স্বামীর আয়ে একটু স্বাচ্ছন্দ্য ফেরানোর চেষ্টা করছেন। যদিও খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি সেই সুখ, চোলাই আসক্ত স্বামী দুর্গার সিঁদুর মুছিয়ে যেদিন বিদায় নিল তখন তার ভরা যৌবন আর নাবালক শিশু। লাজুক , অবগুণ্ঠনবতী দুর্গার লড়াই শুরু হল সেদিন আর সে লড়াই হল, মেয়েদের অকাল বৈধব্য, মায়েদের চোখের সামনে সন্তানের অকাল মৃত্যুকে রুখে দেওয়ার। স্বামীর পথ ধরে যাতে ছেলেও না চোলাই চক্রের খপ্পরে পড়ে সেই লড়াই। ঘরে ঘরে ঘুরে একটি একটি মহিলাকে সংগ্রহ করে একদিন বিশাল প্রমীলা বাহিনী গড়ে তুললেন দুর্গা। আর যে কাজ প্রশাসন পারেনি, পুরুষ পারেনি সেই অসাধ্য সাধন করলেন দুর্গা ও তাঁর প্রমীলা বাহিনী।

২০১৪সালে পুরোপুরি চোলাই মুক্ত গ্রাম হয়ে গেল মালিকপাড়া আর বিদ্যাসাগরের মাটি ছুঁয়ে মালিকপাড়া বদলে নাম হল বিদ্যাসাগরপল্লী। আর তারপর দুর্গার পথেই আজ ঘাটালের বিভিন্ন গ্রামে গড়ে উঠেছে এমনই প্রমীলা বাহিনী।
শুক্রবার সম্বর্ধনা শেষে দুর্গা বলেন, ”পুরস্কার, সম্বর্ধনা এসব এখন বুঝি কিন্তু যেদিন লড়াইটা শুরু করি সেদিন এসব বুঝতামনা, জানতামও না। সেদিন শুধু একটা কথাই বুঝেছিলাম যা আজও বুঝি, মদ শুধু একটা পরিবার নয়, একটা গ্রামকেও শেষ করে দেয়। সেদিনের সেই লড়াইটা না লড়লে আজ আমার ছেলে, গ্রামের অন্য ছেলেরাও হয়ত আমার স্বামীর মত একই পথের পথিক হত!”

দুর্গা যাই বলুন, দুর্গার এই সংবর্ধিত হওয়ার ঘটনার খবর পেয়ে খুশি ঘাটাল। দুর্গার নিজের গ্রামের বিশিষ্ট সমাজসেবী শুকদেব দোলুই বলেন, ” ঘাটালের গ্রামে গ্রামে যেন দুর্গাদির মত দুর্গার জন্ম হয়, তাহলে শুধুই চোলাই নয়, আরও অনেক অসুখ থেকে মুক্ত হয়ে যাবে ঘাটাল।”

RELATED ARTICLES

Most Popular