নিজস্ব সংবাদদাতা: বুকের পাঁজর বের করে ভেঙে, দুমড়ে, মুচড়ে পড়ে আছে একটা সেতু। নিচে শিলাবতী নদীর ওপর বালি আর মাটি দিয়ে তৈরি একটি রাস্তা। ও রাস্তা যতটা না জনতার তার চেয়েও বেশি বালি মাফিয়ার। জেসিপি আর প্রকলার দিয়ে শিলাবতীর বুক খুঁড়ে কোটি কোটি টাকার বালি চলে যায় বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, কোতলপুর, গোঘাট। শুধু হাল ফেরেনা সেতুটার। বর্ষা আসলেই জীবন যন্ত্রনা শুরু হয়ে যায় উত্তরের রয়েন, সোনাকড়া, আগড়খানা, মাজরিয়া, সাতদেউলি, দেউলকুঁদরা, কোড়ুই, হেতোশোল থেকে শুরু করে কাতরা, উত্তরবিল, সন্ধিপুরের। ঘরের আসন্নপ্রসবা কিংবা সাপে কাটা রুগীকে নিয়ে গড়াবেতা গ্রামীন হাসপাতালে যেতে হলে ঘুরতে হয় ১০,১৫,১৮ কিলোমিটার বেশি। যেতে যেতে রুগী মারা যেতেও পারে কিংবা মারুতি ভ্যানের মধ্যেই ডেলিভারি।
উত্তরের ওই সব শয়ে শয়ে মৌজা মায় বাঁকুড়া আর হুগলির চাষিদের উৎপাদিত সবজি এই পথেই, এই লক্ষ্যাটা পুল পেরিয়েই আসে দক্ষিণের রাধানগর গেট বাজারে। এখান থেকে ফড়ে আর তস্য ফড়েদের হাত হয়ে সে সবজি চলে যায় রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে এমন কি ঝাড়খন্ড, বিহার, উড়িষ্যায়।
সানমুড়া গ্রামের সানোয়ার আলি জানালেন, উত্তরের শত শত চাষি কিংবা দালাল সেই সবজি কিনে মোটরসাইকেলে করে লক্ষ্যাটা পুল পেরিয়ে রাধানগর আসে কিন্তু পুলটা পাকার হলে ম্যাটাডোর, হাতিগাড়ি, পিক-আপ ভ্যান ঢুকে যেত আমাদের গ্রামে গ্রামে। মাঝখানের ৫ ফড়ের বদলে সরাসরি বেশি টাকা পেত চাষিরা।
তাহলে পোলটা হয়না কেন? বছর পঞ্চান্নর গোবিন্দ মাইতি জানান, “হবে কী করে? এই তো গতবছর শুনেছিলাম ৩০লক্ষ টাকা ব্যয়ে নতুন কাঠের পোল হবে। তারপর দেখলাম সেই পোলকেই কয়েকটি নতুন খুঁটি আর তক্তা মেরে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। কয়েকমাস যেতে না যেতেই পোল ভেঙে পড়েছে। এবার নাকি আবার পঞ্চায়েত সমিতি চেষ্টা করেছিল কিন্তু ডিপার্টমেন্ট জানিয়ে দিয়েছে আর টাকা দেওয়া যাবেনা। আগে একবছরের মধ্যে পোল কী করে ভেঙে পড়ল জবাব দাও!”
শ্যামনগরের এক বৃদ্ধ চাষি অনুকূল বাবু জানালেন, ‘নয়ের দশকে বাম আমলে প্রথম কাঠের পুল তৈরি হয়েছিল। তারপর ২০১১সালে বাম জামনাতেই পরিকল্পনা করা হয় পাকা সেতুর। সেই জমানাও গেছে আর সেতুর ভবিষ্যৎও গেছে। এখন শুধু বালির জমানা। যত পারো বালি তোল। পুলের গোড়া থেকে অবধি বালি তোলা হচ্ছে। কেউ কিছু বলতে পারবেনা। বালি তোলা হচ্ছে বেআইনি ভাবে জেসিপি, প্রকলার দিয়ে। বালি জমা করা হচ্ছে ফরেস্টের জায়গায় বেআইনি ভাবে এমনকি বালি যাচ্ছে বেআইনিভাবে, ১০ থেকে ২০টন ক্ষমতা যে রাস্তার সেই রাস্তায় ৪০ থেকে ৫০টন বালি নিয়ে যাওয়া হয় গাড়ি পিছু। ফলে রাস্তাঘাটের বারোটা বাজছে।”
শুধু রাস্তার বারোটা বাজছে এমনটা নয়। বালি গাড়ি আর খারাপ রাস্তার দাপটে প্রাণ সংশয় এলাকার মানুষের। প্রায় দিনই ছোটবড় দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। এপাড়ে যেমন শ্যামনগর হাইস্কুল, শ্যামনগর গার্লস ওপারে তেমন মংলাপোতা হাইস্কুল, ধোবাগেড়িয়া হাইস্কুল। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর যাতায়াত। লক্ষ্যাটা গ্রামের প্রামানিক পরিবারের এক গৃহবধূ জানান, ‘এখন করোনার জন্য স্কুল কলেজ বন্ধ আছে বলে রক্ষা। নাহলে ছেলে মেয়েরা স্কুলে গেলে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকি বাবা! কখন কে বালি গাড়ির তলায় চাপা পড়ে!” স্কুলের কথা উঠতেই চলে আসে মংলাপোতা হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক তপন ঘোষের কথা। তপন বাবু এবার গড়াবেতা বিধানসভা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী। এপার ওপর দুপারেই অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর স্যার তিনি। ছেলেমেয়েদের দেখাদেখি বাবা-মায়েদেরও স্যার কিংবা মাস্টারমশাই। সেই স্যার যদি জিততে পারে পোলটা নাকি হয়ে যাবে এমন ভরসা দুপারের বহু মানুষের। তাঁকে ঘিরে ফের ১০বছর আগে পাকা সেতুর পরিকল্পনাটা ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন অনেকেই। কিন্তু কী সেই পরিকল্পনা?
উত্তর দিলেন গড়াবেতার সিপিএম নেতা দিবাকর ভূইঁয়া। বললেন, তৎকালীন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ আর পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামীর উদ্যোগে লক্ষ্যাটাপোল কে পাকা করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পরিকল্পনা মজুর হয়। ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬কোটি টাকা। পূর্তদপ্তর, সেচদপ্তর, জেলাপরিষদ কে কত টাকা ব্যয় করবে তার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। কিন্তু তারপরেই সরকারের পতন হওয়ায় শিলাবতীর জলেই তলিয়ে যায় সেই পরিকল্পনা। এরপর ভাড়া করে বিধায়ক আনা হয়েছে বা আনার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা মানুষকে বলছি কাছের মানুষকে জেতান, পাশের মানুষকে জেতান। আর সেই মানুষটা যদি তপন ঘোষ হন তাহলে তো কথাই নেই!” শিলাবতীর দু’পাড়ের গ্রামে গ্রামে ছেয়ে থাকা লাল পতাকায় যেন সেই স্বপ্নই বোনা হচ্ছে এখন। একটা পাকা সেতুর স্বপ্নে যেন বুঁদ হয়ে আছে নদীটার দু’পাড়ের হাজার হাজার মানুষ।