রানা আচার্য :কোরোনা আতঙ্ক বিশ্ব যখন আতঙ্কিত তখন ভাবের ঘরে চুরি করে অনেকেরই মত প্রতিশোধ নিচ্ছে প্রকৃতি। যে অত্যাচার মানুষ এতদিন প্রকৃতির ওপর চালিয়েছে তার চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে নাকি ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি।নিজেই বের করেছে নিজের উদ্ধারের পথ!
বিজ্ঞানভিত্তিক তর্কে না গিয়ে বলাই যায় যে একথা তো ঠিক প্রকৃতিকে শোষণের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল মানুষ।চূড়ান্ত দূষণের কবলে প্রকৃতিরও যেন সত্যিই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিলো।জল,স্থল,বায়ু প্রকৃতির কোনো অংশই বাদ যায়নি দূষণের কবল থেকে।আর সেই সব দূষণের রকম ফেরই বা কত!কোথাও রাসায়নিক ধোঁয়া তো কোথাও আবার কঠিন রাসায়নিক বর্জ্য । আবার বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো ছিলো প্লাস্টিক দূষণ।। অবিনাশ যোগ্য রাক্তবীজ!
কোরোনা যখন সারা বিশ্বের সভ্যতাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে, তখন এই দুঃসময়েও অন্য অনেকের মতই খুশি হয়েছিলেন পরিবেশ বিদরা।উপগ্রহ চিত্রে নাকি দূষণ-চিত্র বেবাক বদলে গেছে। বিশ্বের অন্য মহানগরের মত কলকাতা তারা ভরা আকাশ দেখেছে, বুকে ভরে নিচ্ছে টাটকা অক্সিজেন।
কিন্তু তারা দেখে তো আর পেট ভরেনা। লক ডাউনে ঘরবন্দী জনতা খাবে কি? অতএব ত্রান চাই, ত্রান! সরকার কবে সচল হবে ঠিক আছে ?তাই সাধ্যমত ক্ষমতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ব্যক্তি, বিভিন্ন সংগঠন,স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা গুলি। তাদের দক্ষিণ্যে কোথাও কোথাও মুখে অন্ন উঠছে বহু মানুষের।
এতদূর ঠিকই ছিল।কিন্তু সাথে একটা আশঙ্কাও মাথা চাড়া দিচ্ছে , আশঙ্কা না বলে বোধহয় ভয়াবহ বাস্তব বলাই ভাল। এই যে এত চাল,ডাল, আলু, রান্না করা খাবার মানুষের দোরে দোরে পৌঁছাচ্ছে, তার বাহন কী ? সেই প্লাস্টিক! যার বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে সবে মাত্র যুদ্ধটা শুর করেছিল ভারত। এই চূড়ান্ত বিপদের মুখে এক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমরাও সেই মারাত্মক, ভয়াবহ শত্রুটাকেই আপন করে নিলাম ! প্লাস্টকের ক্যারি ব্যাগে ত্রান ছড়িয়ে দিতে গিয়ে ভুবন জোড়া বিছিয়ে দিচ্ছি প্লাস্টিকেরই মরণ ফাঁদ! এই ক’দিনে কত মিলিয়ন টন প্লাস্টিক রূপী গ্রেনেড ভোরে দিলাম ধরিত্রীর পেটে? শহর, শহরতলি গ্রাম আরও গঞ্জে! সেই প্লাস্টিক! যার বিরুদ্ধে সবে মাত্র গড়ে উঠছিল সচেতনতা! আমরা বুঝতে শুরু করেছিলাম , প্লাস্টিক এমনই এক মারণাস্ত্র, জল,স্থল,বায়ুকে দূষণে ভরিয়ে তুলতে যার জুড়ি মেলা ভার।
প্রশ্ন উঠলো সমাজ মাধ্যমে। কাজটা কী ঠিক হচ্ছে? নেটিজেন রা উত্তর দিলেন কথা সত্যি, তবে এতবড় বিপদে সময়! তাহলে কী আমরা এক খাদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টায় আরো গভীর এক খাদের দিকে এগিয়ে যাবো?
না, খুব বেশি দুরে যাওয়ার আর খুব বেশি ভাবার দরকার নেই। গত বর্ষার মরশুম আর খড়গপুর শহরের কথা ভাবাই যাক, মাত্র দু’দিনের বৃষ্টি অচল করে দিয়েছিল গোটা শহরকে। স্তব্ধ হয়ে গেছিল জনজীবন , বিশেষ করে শহরের নিচু অংশগুলো। খড়গপুর প্ল্যাটফর্ম উপচে পড়া জল, জলে ডুবে যাওয়া সাবওয়ে, হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে পেরিয়ে আসা বোগদার মুখ, জল থই থই পুরসভা, একাধিক স্কুল। গতবছর বর্ষায় এ শহরের জলছবি ভোলেনি শহরবাসী। যার প্রধান কারণ নির্দিষ্ট করা হয়েছিল প্লাস্টিককেই। এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে আমাদের রক্ষা করবে কে?
ত্রানের চাল ডাল আলু যাবে মানুষের পেটে আর হাত ঘুরে ঘুরে, বাতাসে উড়ে উড়ে কিলো কিলো প্লাস্টিক এসে পড়ছে শহরের অলিতে গলিতে, নালা নর্দমায়। এমনিতেই পরিকল্পিত পয়:প্রণালী নেই এই রেলশহরে।নেই কঠিন বর্জ্য প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থাও।
প্রশ্ন উঠবে এখন, এই বিপদের সময়, এ প্রসঙ্গ কেন? উত্তর ভাবনাটা এখনই ভাবার। কারন এখনই যে বেশি করে বারোটা বাজানোর আয়োজন। তাছাড়া কথায় আছে বিপদেই তো মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করতে হয়। মানুষ তো আর পশু নয় যে সিঁদুরে মেঘ দেখে আগুনের দিকে ঝাঁপ দেবে! ত্রাণের-দানের হাত ধরে সেই প্লাস্টিকের বহর আরো বাড়ছে। তাই সাধু সাবধান। এ শহরের বর্ষার জলছবি পাল্টানোর দ্বায়িত্ব কিন্তু অনেকাংশে এশহরের নাগরিকদের হাতেও। ত্রাণের-দানের জন্য কি আমরা বেছে নিতে পারিনা কাগজের ঠোঙা বা কাপড়ের ব্যাগ? নচেৎ শুধুই এশহর নয়, ত্রানের প্লাস্টিক বানে ভাসাবে বাংলাকেও।