পলাশ খাঁ, গোয়ালতোড় :- যুগ যুগ ধরে যাঁরা আলোর প্রদীপ বানিয়ে যান তাঁরা আজও সেই অন্ধকারে। একটা সমাজ কতটা এগিয়েছে এটাই হয়ত তার ব্যঙ্গ হয়ে রয়ে গেছে আজও। এই যেন রবি ঠাকুরের সেই বাতিওয়ালা, যারা পথে পথে বাতি জ্বালিয়ে বেড়ায় তাদেরই বাড়ি থাকে অন্ধকারে। আলোর উৎসবের আগে ঠিক এই অবস্থায়ই কুমোরপাড়াতে। দীপাবলি কে যে আলোকিত করে তারাই আজ মহা সংকটের মুখে। শালবনীর ভাতমোড় কিম্বা চন্দ্রকোনা রোডের ডুমুরগেড়িয়ার কুমোর পাড়াতে কান পাতলেই শোনা যাবে পুর্বপুরুষ ধরে মাটির কাজ করে আসা কুমোর দের দীর্ঘশ্বাস।
এমনিতেই চায়না আলো আর প্লাস্টিকের একছত্র অধিপত্যে মাটির প্রদীপ কিম্বা সরা, হাড়ি, মালসা ইত্যাদি বাজার থেকে উধাও তার উপরে অতিমারির কারনে লকডাউন এই দুয়ের জোড়া ফলায় আজ সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছে কুমোরেরা। শালবনীর ভাতমোড়ে ২০ -২৫ টি কুমোর বাড়ি থাকলেও এখন প্রায় সবাই এই মাটির কাজ করা ছেড়ে দিয়েছেন। মাত্র সাত টি পরিবার এখনো পুর্ব পুরুষদের দেওয়া শিক্ষা ধরে রেখে এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। শালবনীর ভাতমোড়ের বাসিন্দা ষাটোর্ধ সনাতন দাস, বেনু দাস, ভগী পাল, হেলু দাস রা এখনো চাকা ঘুরিয়ে হাতের সাহায্যে নানান আকৃতির মাটির কলসি, সরা প্রদীপ তৈরি করেন।
কিন্তু তাদের অবর্তমানে এই কাজ যে বন্ধ হয়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য। কারন পরিশ্রমের তুলনায় রোজগার খুবই কম। তাই বর্তমান প্রজন্মের ছেলেরা এই কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে কেউ বা চাষের কাজে কিম্বা অন্যান্য পেশায় নিযুক্ত হয়ে পড়েছে। সনাতন দাস জানান, সুদুর লালগড়ের বামাল এলাকা থেকে ট্রাক্টারে করে মাটি আনতে খরচ পড়ে ট্রাক্টার পিছু দু হাজার টাকা। এরপর সেই মাটি প্রস্তুত করে তৈরি করা হয় মাটির জিনিস। তারপর সেগুলিকে রোদে শুকিয়ে আগুনে পোড়াতে হয়৷ আগুনে পোড়ানোর জন্য জ্বালানি সংগ্রহ করতে জঙ্গলে ছুটতে হয়। তারপর সেগুলি বাজারজাত করা হয়। এরপর এখন বাজারে প্লাস্টিকের নানান জিনিস ছেয়ে ফেলেছে। ফলে মাটির কলসি বা সরার চাহিদা সেরকম আর নেই। চাহিদা বলতে যেটুকু তা হলো এই পুজোর সময়।
সনাতন দাসের স্ত্রী মৃদুলা দাস জানান এবার দীপাবলির জন্য এক হাজার প্রদীপ বানিয়েছি, মাত্র দেড় টাকা দামে এখনো পর্যন্ত সে রকম বিক্রিবাটা নেই৷ তিনি আক্ষেপ করে আরো জানান, এই কাজে রোজগার না থাকায় বর্তমান প্রজন্মের ছেলেরা এই কাজে আগ্রহ দেখাচ্ছে না, আমার এক ছেলে বাইরে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করতো।
লকডাউনের কারনে দীর্ঘ প্রায় আট নয় মাস ধরে বাড়িতে বসে আছে। আর এদিকেই এই মাটির জিনিস গড়ে সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছি তাই বাধ্য হয়েই জনমজুরের কাজে যায়। শুনছি সরকারের পক্ষ থেকে নানানরকম ভাতা দেওয়া হচ্ছে কিন্তু আমরা সেই অন্ধকারেই রয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা করলে হয়তো বা পুর্বপুরুষের এই শিল্প কে আমরা বাচিঁয়ে রাখতে পারবো।