শশাঙ্ক প্রধান; পশ্চিম মেদিনীপুর: বয়সটা ১৮ হলেও মনটা বড় হয়নি তেমন করে। তার ওপর বোবা হওয়ায় সমস্যা ছিল অনেক কিন্তু দুনিয়ায় মা যদি থাকে তবে কত অসাধ্যই না সাধন হয়ে যায়! তেমনই এক অসাধ্য সাধনের ঘটনার স্বাক্ষী রইল পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা।
দুই মমতাময়ী মায়ের প্ৰচেষ্টা আর জুকারবার্গের ফেসবুকের হাত ধরে পরিবারের নিখোঁজ হওয়া এক মুক ও বধির সন্তানকে ফিরে পেল ১০০কিলোমিটার দুরে বাঁকুড়া জেলার সারেঙ্গা থানার আমঝোল গ্রামের মা। শুক্রবার সকালে, ১০দিন পরে বাঁকুড়ার সুমন্ত দুলে নিজের মাকে পেয়ে যখন তাঁর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন ডেবরার দুই মা মমতা মিশ্র আর শ্রাবন্তী দাসের চোখে আনন্দের জল।
গত সাতদিন আগে পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা থানার অন্তর্গত হাওড়া-মুম্বাই ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে হরিমতী উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের মাঠের এক বটগাছের তলায় মুক ও বধির মহীতোষ দুলেকে দেখতে পান মমতা মিশ্র। পায়ে দগদগে আঘাতের চিহ্ন। মায়ের মমতায় তিনি তাকে খাইয়ে যত্ন করে লালন করছিলেন। স্থানীয় কিছু যুবক বিষয়টি নজর করে ফেসবুকে পোষ্ট করেন। সেই পোষ্ট দেখেই ছুটে আসেন ডেবরা রাধামোহনপুরের আরেক মা শ্রাবন্তী দাস। পেশায় আশাকর্মী শ্রাবন্তী বুধবার পৌঁছে যান হরিমতীর মাঠে।
ইশারায় ওই মানসিক সমস্যা যুক্ত কিশোরের সঙ্গে কথাবার্তা বলে শ্রাবন্তী বুঝতে পারেন ছেলেটি কোনও গৃহস্থ পরিবারের যে পথ হারিয়ে চলে এসেছে। তিনি আরও বুঝতে পারেন জাতীয় সড়ক ধরে আসার পথে গাড়ির ধাক্কায় আহত হয়েছে কিশোর।
এরপর তিনি তার ক্ষতস্থান ধুইয়ে ওষুধ লাগিয়ে যত্ন করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন। দুই মায়ের যত্নে কিশোর সুমন্ত অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এরপর বৃহস্পতিবার ছেলেটির ছবি, নিজের ফোন নম্বর দিয়ে সন্ধ্যায় ফের ফেসবুকে পোষ্ট করেন তিনি।
শ্রাবন্তী জানায় ফেসবুকে পোষ্ট করার পরই প্রচুর শেয়ার হয়। ২ঘন্টা পরেই ফোন পান এক ব্যক্তির যিনি জানান ছেলেটি তাঁদের গ্রামের। রাত ১২টা নাগাদ ওই ব্যক্তি মহীতোষের বাড়িতে গিয়ে শ্রাবন্তীর সাথে কথা বলিয়ে দেন কিশোরের বাবা-মার সঙ্গে। শ্রাবন্তী তাঁদের ঠিকানা জানিয়ে দেন। মধ্যরাতেই গাড়ি ভাড়া করে রওনা দেয় সুমন্তর পরিবার। তারপর সকালে পৌঁছে যান হরিমতী স্কুলের মাঠে। এরপর দুই মায়ের কাছ থেকে নিজের মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়া।
শ্রাবন্তী জানান, “ওনারা সমস্ত পরিচয় পত্র এনেছিলেন কিন্তু মা আর নিজের পরিবারকে দেখে কিশোর যে ভাবে আনন্দে উদ্বেল হয়ে পড়েছিল, ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মায়ের কোলে আর ওঁদের আনা গাড়িতে বসে ইশারায় বলেছিল আমাকে এখুনি বাড়ি নিয়ে চল, তার চেয়ে আর বড় কিছু পরিচয় হয়না।”
সন্তানকে ফিরে পেয়ে খুশির কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন মহীতোষের মা লক্ষী। মমতা ও শ্রাবন্তীর পাশাপাশি সমগ্র ডেবরাবাসীকেই নিজের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেছেন লক্ষী দুলে বলেছেন, “আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে বেঁধে রাখল ডেবরা। এই ঋণ আমি কোনও দিনও ভুলতে পারবনা।”
শ্রাবন্তীও জানিয়েছেন, “এই কৃতিত্ব মমতা মিশ্র আর ডেবরাবাসীরই। মমতা যে ভাবে গত কয়েকদিন ধরে কিশোরকে সারাক্ষন আগলে রেখেছেন, যত্ন করেছেন আর ডেবরাবাসী এত পরিমানে ওই পোষ্ট শেয়ার করে ছিলেন যে ২ঘন্টার মধ্যেই ছেলেটার ঠিকানা জানতে পারা গেছিল।”