নিজস্ব সংবাদদাতা: মুদির দোকান সামগ্রী বেচতে নারাজ, বাড়ি ওয়ালা বলছে, হয় হাসপাতাল ছাড় নয় বাড়ি। বাড়ির লোক বলছে, এখন হাসপাতালে যাওয়ার দরকারই নেই। রাস্তাঘাটে লোক এড়িয়ে চলছে, কেউ কেউ অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করছে। যে কোনোও মুহূর্তে মার খেয়ে যেতে পারি বলছেন ডেবরা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যকর্মীরা! আমরা যাঁদের বাহারি নাম দিয়েছি কোভিড যোদ্ধা বলে। লোক দেখাতে যাঁদের হাতে ফুল গুঁজে দিয়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছি লাইক আর কমেন্ট পেতে। আর বাস্তব হচ্ছে চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি, হয়রানি এমনকি হুমকির মধ্যে পড়তে হচ্ছে চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতালের কর্মীদের।
অবস্থা এতটাই খারাপ যে, কর্মচারীরা হাসপাতালের সুপারের কাছে আবেদন করেছেন হয় তাঁদের হাসপাতালের ক্যাম্পাসের মধ্যে থাকার ব্যবস্থা করা হোক নতুবা ছুটি দিয়ে দেওয়া হোক। জানা গেছে ডেবরা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের এক চিকিৎসক কোভিড হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হন। পরে তারই সূত্র ধরে আরও এক চিকিৎসক, ২জন নার্স ও এক রাঁধুনি করোনা পজিটিভ হওয়ার পর থেকেই এলাকায় ব্যাপক আতঙ্ক ছড়ায় আর তারপরই এলাকার মানুষজনের একটা অংশ অমানবিক আচরন করেই চলেছেন।
সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের পেছনেই আনন্দপল্লীর বেশকিছু বাড়িতে ভাড়া থাকেন এই সব চিকিৎসাকর্মীরা। সেই বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে পাড়া ছেড়ে চলে যেতে। এক চিকিৎসা কর্মী জানিয়েছেন, আমাকে অবিলম্বে বাড়ি ছাড়তে বলেছেন বাড়িওয়ালা। সামনের দোকানগুলোতে কিছু কিনতে গেলে খিঁচিয়ে উঠছেন দোকানদাররা। একজন মুদি দোকানদার স্পষ্ট মুখের ওপর বলে দিয়েছেন, আমার দোকানে মাল নিতে আসবেননা, আপনি এলে অন্য খদ্দেররা দোকানে আসবেনা।
আনন্দপল্লীতে ভাড়াতে থাকেন এক নার্স। বলছেন, ” আগে মাথা উঁচু করে হেঁটে যেতাম, এখন মুখ লুকিয়ে হাঁটতে হয়। পাড়ার মোড়ে জটলা করে থাকা ছেলেরা পেছন থেকে কটূক্তি করে, করোনা নিয়ে আসছে, পাড়ায় ছড়াবে বলে। এক সময় যাদের মুখে চোখে সম্ভ্রম লক্ষ্য করেছি এখন তারাই যেন হিংস্র হয়ে উঠেছে। কুৎসিত মন্তব্যও শুনেছি। শুধু আমি নই পরিবারের লোকেদেরও কার্যত মানুষের কটূক্তির মুখে পড়তে হচ্ছে। বিশ্বাস করুন, মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছি।”
শুধু হাসপাতালের আশেপাশেই নয়, জল গড়িয়েছে আরও অন্য জায়গাতেও। হাসপাতালের বেশকিছু কর্মচারী থাকেন বালিচক স্টেশন পাড়ার দিকে। সেখানেও একই অবস্থা। এক মধ্য বয়সী চিকিৎসা কর্মী জানালেন, আমাদের অবস্থা এখন অনেকটাই মধ্যযুগীয় জাতিভেদ প্রথার মত। পরিচিত চায়ের দোকানে বসে চা খেতে পারিনা। মাত্র কয়েকদিনে যেন পৃথিবীটা বদলে গেছে। চায়ের দোকানে ঢুকলে বাকিরা যেন পালাতে পারলে বাঁচে। এমনকি শিক্ষিত মানুষও এড়িয়ে চলে।”
ঘটনা হচ্ছে অনেকেই ভয়ে বা চাপে হাসপাতালে আসছেননা, হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলিতে কর্মী সঙ্কটও দেখা দিয়েছে কিছুটা। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ মাইকিং করেছে, সুপার একটি আবেদনপত্র ছাপিয়ে এলাকার মানুষের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, চিকিৎসাকর্মীদের সাহায্য করার জন্য। বলেছেন, এরা আপনাদেরই চিকিৎসার জন্য নিবেদিত কিন্তু খুব বেশি কাজ হচ্ছেনা। চাপা উত্তেজনা কাজ করছে এলাকায়। ভীত সন্ত্রস্ত চিকিৎসাকর্মীরা।
কর্মীদের আরও অভিযোগ, এই সময়ে এলাকায় এসে মানুষকে বোঝাতে পারতেন যে রাজনৈতিক কর্মী বা নেতারা তাঁদের মধ্যেও কোনও সংগঠিত প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা। মুখে বলছেন, এসব করা উচিৎ নয় কিন্তু এলাকায় নেমে মানুষকে বোঝাতে, সচেতন করতে তেমনভাবে কাজে নামছেননা তাঁরা বরং পাড়ার ছোট বড় অনেক নেতাই স্রোতে গা ভাসিয়েছেন। ফলে সমস্যা বেড়েই চলেছে অথচ হাসপাতালে কোনও অনুষ্ঠান হলে আর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের কৃতিত্ব নিতে এরাই আগে এগিয়ে আসেন।
এরই মধ্যে শঙ্কা জাগিয়ে স্থানীয় একটি পরিবারের ২সদস্য করোনা আক্রান্ত হয়েছেন বলে শুক্রবার খবর পাওয়া গেছে। ওই পরিবারে ভাড়া থাকেন একজন চিকিৎসক যিনি সদ্য করোনা আক্রান্ত হয়েছেন আর এই ঘটনা শোনার পর থেকে হাসপাতাল কর্মীদের দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেছে।