- শশাঙ্ক প্রধান : কাগজে কলমে সব হয়েছে। বিডিও বলেছেন প্রধান কিংবা থানার ও.সিকে। প্রধান বলেছেন উপপ্রধানকে, উপপ্রধান বলেছেন পঞ্চায়েত সদস্যকে। না, পঞ্চায়েত সদস্য অবশ্য তিনি নিজেই আর অভিযুক্তও তিনি নিজেই ফলে তাঁর কাছেই এসে থমকে গেছে সরকারের আইন। পুলিশও নাকি বলে গেছে কাউকে বয়কট করা যাবেনা কিন্তু না, সেসব কথা কেউ শোনেনি। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ডেবরা থানার কালুয়া আকুব গ্রামে আইন চলে গ্রামের মোড়ল আর রাজনৈতিক নেতার মত, ভারতীয় সংবিধান এখানে অচল, অচল পশ্চিমবাংলা বিধানসভার আইনও। তাই নেতা, মোড়ল, হর্তাকর্তাদের হুকুম না মানলেই বয়কট। আর সেরকমই তিন দফার বয়কটে ওই গ্রামে প্রায় ১৮/২০টি পরিবার। তাঁদের ধোপা, নাপিত, ব্রাহ্মন বন্ধ। মুদি দোকান, ধান ভাঙার কল বন্ধ। দেবস্থানে যাওয়া বন্ধ।
না, বন্ধের তালিকা এখানেই থেমে নেই। তালিকা আরও গভীরে। জ্ঞানপাপী রাজনৈতিক নেতা আর গ্রামের মাতব্বরদের ফতোয়ায় দুই সোমত্ত মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেননা একটি পরিবার। এক গৃহবধূ জানিয়েছেন তাঁর ৯ মাসের মেয়ের অন্নপ্রাসন করতে পারেননি তিনি। কী করে হবে? ধোপা নাপিত ব্রাহ্মন ছাড়া মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান সম্ভব নয় যে হিন্দুদের অনুষ্ঠানে। শুধু তাই নয়, মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে ওই বয়কট হওয়া পরিবারগুলিতে যেতে পারবেননা প্রতিবেশীরাও। গেলে বয়কট করা হবে তাঁদেরও। সেরকমভাবেও বয়কট হয়ে রয়েছে দু’একটি পরিবার। বয়কটের কারনে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় টাকা ঢুকেও বাড়ি করতে পারছেনা কয়েকটি পরিবার কারন ইমারত সামগ্রী আনতে দেওয়া হচ্ছেনা। বাড়ি বানানোর জন্য এক ব্যক্তির কিনে আনা বালি পড়ে আছে মূল রাস্তার ধারে। পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে কিন্তু গ্রামের রাস্তায় আনতে দেওয়া হচ্ছেনা।
কিন্তু বয়কটের কারন কী? দুটি পরিবারকে বয়কট করা হয়েছে গ্রামের কয়েকটি মানুষের মাঠের ধান আবলীলায় যাতে বাড়ি আনা যায় ছোট গাড়ি বা ঠেলায় করে সেই কারণে তাঁদের কৃষি জমির ওপর দিয়ে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে রাস্তা বানানোর জন্য। ওই দুটি পরিবারের বক্তব্য অন্যদের ধান আনার জন্য তারা তাঁদের কৃষি জমি নষ্ট করবেন কেন? এ রাস্তার পরিকল্পনা তো গ্রামের সর্বসাধারনের জন্য নয়। তাহলে নিজেদের সমবৎসরের ধান নষ্ট করবেন কেন? অতএব বয়কট বিশ্বরূপ দাস গোস্বামী আর নকুল চন্দ্র হাইতের পরিবার।
অন্যদিকে কয়েকটি পরিবারের বাস্তুজমির ওপর দিয়ে রাস্তা করতে দিতেই হবে। যাঁদের বাস্তু তাঁরা বলছেন যেটা সরকারি জমিই নয় সেখান দিয়ে রাস্তা হবে কী করে? তাছাড়া এটা তাঁদের পৈতৃক ভিটে। বাড়ির পাশ দিয়ে মানুষ হেঁটে যায় শটকার্ট করার জন্য ঠিক আছে। তাবলে পাকাপাকি রাস্তা! পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে গেছেন তাঁরা। আদালত তাঁদের পক্ষেই রায় দিয়েছেন। অতএব বয়কট। বয়কটের শিকার গ্রামের গাঁতাইত পদবি ধারী নরায়নচন্দ্র, বাদল, অশোক, অসিতের পরিবার। বন্ধ চাষবাস, বন্ধ গ্রামের দোকানপাট, টিউশিনি মাস্টার, ১০০দিনের কাজ থেকে শুরু করে গ্রামের মন্দিরে পুজো দেওয়ার অধিকার।
অন্যদিকে প্রায় ১ডজন পরিবার বয়কট আরও এক কারনে। গ্রামের কিছু জমি খাস ঘোষিত হয়েছে সরকারের দ্বারা। উদ্বৃত্ত সেই জমির পাট্টাসত্ত্ব সরকার বিলি করে দিয়েছেন খান দশেক আদিবাসী পরিবার ও জনৈক নারায়ন জানাকে। গ্রামের জমি তাঁরা কেন সত্ত্ব পেয়েছেন তাই বয়কট তাঁরাও। একটি পরিবার জানিয়েছেন তাঁদের বয়কট করা হয়েছে কারন তাঁরা বয়কট হওয়া একটি পরিবারের আমন্ত্রণে বাড়িতে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করেছিলেন। যে ৯ মাস বয়সের শিশুকন্যার অন্নপ্রাসন করতে পারা যায়নি তাঁর মা জানালেন, বাড়ির মধ্যেই থাকতে হয় আমাদের। শিশুটিকে নিয়ে একটু পাশের বাড়িতেও যেতে পারিনা। প্রতিবেশীরা মিনতি করে, এসোনা আমাদের বাড়ি, এলে আমরাও বয়কট হয়ে যাব।
কেউ বয়কট হয়ে আছে দেড় বছর, কেউ আবার ৬/৭ মাস। বয়কটের কথা জেনেও স্বীকার করেনা প্রধান, উপপ্রধানরা। ডুঁয়া ১০/১ গ্রাম পঞ্চায়েত সন্তু মন্ডল বলছেন, ‘না, না কেউ বয়কট হয়নি। গ্রামের নিয়ম টিয়ম না মানায় ওদের মন্দিরে যাওয়া নিষেধ করা হয়েছে মাত্র।’ আর যার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ সেই উপপ্রধান এবং ওই গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য গোবিন্দ সামই বলছেন, কোথাও কোনও বয়কট নেই। অভিযোগ ভিত্তিহীন। তৃণমূলের ব্লক নেতাদের দাবি তাঁরা এই বয়কট সমর্থন করেননা কিন্তু গোবিন্দ সামই ওই অঞ্চলের তৃনমূল সভাপতি তাই তাঁকে ঘাঁটাতে চায়না কেউ। আর প্রশাসনের ভাঙা রেকর্ড বেজেই চলেছে, দেখছি, দেখব।