অশ্লেষা চৌধুরী: অভিশপ্ত ১৩তলা, যেখানে বিধ্বংসী আগুনে ঝলসে গিয়েছে তরতাজা ৯ টি প্রাণ। ৮ জনের দেহ শনাক্ত করা গেলেও একজনের পরিচয় মেলেনি এখনও। সূত্রের খবর, তাঁর ডিএনএ টেস্ট করা হতে পারে। স্ট্র্যান্ড রোডে পূর্ব রেলের ভবনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনায় উঠছে একাধিক গাফিলতির অভিযোগ। আর চলছে একে অপরের ওপর দোষ চাপানোর পালা।
সেই অফিসেই কর্মরত আধিকারিক জানান রিজার্ভার, অটোমেটিক স্প্রিঙ্কলার কিছুই ছিল না অফিসে। ৩টে সিলিন্ডার থাকলেও ছিল না কোনও অটোমেটিক সিলিন্ডার। জানা গিয়েছে কম আগুন নেভানোর জন্য সামান্য ব্যবস্থা থাকলেও বড় সড় দুর্ঘটনা মোকাবেলার মতন ব্যবস্থা সেখানে ছিল না।
সোমবার, কলকাতার ১৪ নাম্বার স্ট্যান্ড রোড এলাকায় নিউ কয়লাঘাট বিল্ডিং এর ১৩ তলায় আগুন লাগে। পূর্ব রেলের ঐ দফতরে লাগা বিধ্বংসী আগুনের খবর পেয়েই দমকলের ৬ টি ইঞ্জিন পৌঁছায়, পরবর্তীতে আরও ইঞ্জিন এসে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় আগুন নেভানোর কাজে জুড়ে যান। প্রায় ৪ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু ততক্ষনে ঘটে যায় চরম ও মর্মান্তিক সেই ঘটনাটি। ৪ জন দমকল কর্মীসহ ঝলসে যায় ৯ টি তরতাজা প্রাণ। প্রথমে ৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও পরে আরও ২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়। জানা যায় উদ্ধার কাজ করতে গিয়ে দমকল কর্মীরা দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যান; একদল সিঁড়ি দিয়ে ওঠার চেষ্টা করেন, আর এক দল তাড়াহুড়োয় বেছে নেন লিফট। আর তাতেই বিপত্তি ঘটে। লিফটে আটকে ঝলসে সেখানেই মৃত্যু হয় তাদের। একটি লিফটে ৭ জনের দেহ মেলে এবং ওপর লিফটে ২ জনের। ততক্ষণে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে কর্মরত অধীর ও ব্যাকুল নয়নে সেই অফিসে কর্মরতদের পরিবারের লোকজনেরা অপেক্ষা করতে থাকেন। তার সাড়ে ১১ টা নাগাদ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান মুখ্যমন্ত্রী, ওনাকে দেখে পরিবারের লোকেরা আরও ভেঙে পড়েন। কারও ছেলে, কারও মেয়ে জানতে চান, ‘আমার বাবার খবর পাওয়া গেল কী?’ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আছে, তাদের সন্ধান চলছে, তাদের প্রতি সমবেদনা জানান।
কিন্তু কীভাবে ঘটল এই দুর্ঘটনা? জানা যায়নি প্রকৃত কারণ। ঘটনাস্থলে মঙ্গলবার এসেছে ফরেন্সিক দল। নিউ কয়লাঘাট রেলভবনে অগ্নিকাণ্ডে গাফিলতি কার, সে নিয়ে ইতিমধ্যেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করেছে হেয়ার স্ট্রিট থানা। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪এ (গাফিলতি) এবং দমকল আইনের ১১জে ও ১১ এল ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। গোটা ঘটনায় রেলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘটনার পরই সেখানে যান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “রেলের জায়গা, রেলের সবটাই। তাদের ওপরও দায়িত্ব বর্তায়। ওরা কেউ আসেনি। দমকল থেকে ম্যাপ চাওয়া হয়েছিল। এত বড় বিল্ডিংয়ে কোথায় কী রয়েছে জানা সহজ হতো। সেই সহযোগিতাও করেনি বলে দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু আমাকে জানিয়েছেন। মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি চাই না। ফায়ার ব্রিগেডের কর্মী, আধিকারিক থেকে শুরু করে পুরমন্ত্রী, দমকলমন্ত্রী, সকলে আছেন। আগুন নিয়ন্ত্রিত, তবে প্রাণগুলো চলে গিয়েছে।”
তবে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসহযোগিতার অভিযোগ উড়িয়ে রেলের পদস্থ কর্তারা ঘটনাস্থলে ছিলেন বলে ট্যুইট করলেন পীযূষ গোয়েল। পরপর তিনটি ট্যুইট করেন রেলমন্ত্রী। ট্যুইটে তিনি লেখেন, মৃত ৯ জনের পরিবারকে আন্তরিকভাবে সমবেদনা জানাচ্ছি। রেলের জেনারেল ম্যানেজার-সহ একাধিক কর্তা ঘটনাস্থলে রয়েছেন। রাজ্য সরকারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে সব কাজ করা হয়েছে। রাজ্যের সঙ্গে সবরকম সহযোগিতা করা হচ্ছে। এই ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও রেলমন্ত্রী তাঁর ট্যুইটে জানিয়েছেন। পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার মনোজ যোশী দাবী করেছেন যে, ঘটনাস্থলে রেলের আধিকারিকরা ছিলেন। তবে বাড়িটির ম্যাপ যে পাওয়া যায়নি সেকথা স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে, মঙ্গলবার বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান রাজ্যপাল। সেখানে গিয়ে এতবড় অগ্নিকাণ্ডের জন্য রাজ্যকেই দায়ী করেন তিনি। রাজ্যপাল বলেন, রেল তার নিজের মতো কাজ করেছে। কিন্তু দমকলের আরও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার দরকার ছিল। দমকল কেন দেরিতে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় সেই প্রশ্নও তোলেন তিনি। তাঁর দাবী, দমকলকর্মীদের সঙ্গে আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না। তাছাড়া গোটা ভবনের বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে লিফটে কেন ঢুকেছিলেন দমকলকর্মীরা, সে প্রশ্নও তুলেছেন রাজ্যপাল। রেলের ভূমিকা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেননি। তাঁর বক্তব্য, রেল তার মতো তদন্ত শুরু করেছে। চার অফিসারকে নিয়ে কমিটি তৈরি হয়েছে। আগুন লাগার কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ঘটনায় রাজনৈতিক রং লাগতেও সময় নেয়নি একেবারেই। রেলের উদাসীনতার যে অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রী তুলেছিলেন, তাকে কটাক্ষ করে ট্যুইট করেছেন রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপির সহকারী পর্যবেক্ষক অমিত মালব্য। অমিত মালব্য লেখেন, যখনই পশ্চিমবঙ্গে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ক অপরকে দোষারোপ করেন। ২০১৬ সালের ব্রিজ ভেঙে পড়া কিংবা আমরির অগ্নিকাণ্ডের জন্য তিনি বামপন্থীদের দায়ী করেছিলেন। ধুলাগড়ের দাঙ্গার জন্য সোশাল মিডিয়াকে দায়ী করেন। আর আজ স্ট্র্যান্ড রোডের মৃত্যুর ঘটনায় তিনি রেল কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছেন।
তবে এই মর্মান্তিক ঘটনার পেছনে দায়ভার নিয়ে আঙুল উঠছে বেশ কয়েকটি দিকে। একদিকে অফিসে কর্মরত আধিকারিকদের বয়ান অনুযায়ী অপর্যাপ্ত ব্যবস্থার অভিযোগ, সেই সাথেই দমকল কর্মীদের লিফট ব্যবহার ও অনুন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অভিযোগ, পাশাপাশি রেলের অসহযোগিতার অভিযোগও উঠে আসছে। এবার ঘটনার নেপথ্য আসল কারণ কী ছিল তা তো সঠিক তদন্তের পরেই জানা যাবে।