নিজস্ব সংবাদদাতা: বড়টির বয়স সবে ১৮ পের হয়েছে, ছোটটির ১৪। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর থেকে ২২০০কিলোমিটার দুরে মুম্বাই নগরীর লালা সুপার এলাকার কয়েক কোটি টাকার ফ্ল্যাটে বন্দি দুই ভাই। ৩১মে করোনা কেড়ে নিয়েছে বাবাকে ১১দিনের মাথায় ১১ই জুন মা কেও। ভয়াবহ করোনা বিদ্ধস্ত দেশের সবচেয়ে বড় ওই কালান্তক শহরে এখন শুধুই সম্বল মৃত বাবা-মার স্মৃতি। মৃত নগরী মুম্বাইয়ে এখন বন্ধু নেই, পড়শি নেই, আত্মীয় স্বজন নেই, শুধু আছে মৃত্যু ভয় আর অনন্ত নিঃসঙ্গতা। তাই নিয়ে বসে রয়েছে সদ্য আঠারো পেরিয়ে আসা এবছরই কলেজে ভর্তি হওয়া সুমন আর ক্লাশ নাইনে পড়া রৌনক।
পশ্চিম মেদিনীপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম দাসপুরের বড়শিমুলিয়া। সেই গ্রামেরই পাড়ুই পরিবারের চার ভাইয়ের এক ভাই অজিত পাড়ুই। অভাবের সংসার বাঁচাতে সাড়ে তিনদশক আগে মুম্বাই রওনা দিয়েছিলেন সোনার গহনা বানানোর কাজ শিখতে যেমন করে এই দাসপুরেরই ৩০হাজার ছেলে গিয়েছে। সোনার চেন পালিশ করা দিয়ে শুরু করে ধিরে ধিরে রপ্ত করয়েছিল গহনা বানানোর সমস্ত কৌশল। সামর্থ্য ছোট হলেও স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়ার। অলীক স্বপ্ন নয়, তিল তিল করে সেই স্বপ্নের নির্মান করেছে অজিত। সোনার সামান্য কারিগর থেকে হয়েছিলেন মুম্বাইয়ের অভিজাত স্বর্ন বিপনীর প্রান কেন্দ্র জুহুরি বাজারের একটি জুয়েলারি দোকানের মালিক যেখানে কোটি কোটি টাকার সোনার গহনা আর কয়েকডজন কর্মচারী কাজ করে।
এরপর বিয়ে করেছেন অজিত। স্ত্রী ঝুমা আর দুই সন্তান সুমন আর রৌনককে নিয়ে মুম্বাইয়ের লালাসুপার এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে সুখী জীবন চলছিল আজিতের। কিন্তু সব কেড়ে নিল করোনা। ৩১শে মে আজিত যখন মারা গেলেন তখন মাত্র ৫৫বছর বয়স আর তার ১১দিন পরে ৪৮ বছরে ঝুমাও। মা বাবাকে শেষ দেখাও দেখতে পারেনি দুই ভাই। পুলিশই দাহ করেছে সেই লাশ। বাবার মৃত্যুর শোকের ওপরেই মায়ের মৃত্যু দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে দুই কিশোরকে।
আতঙ্ক নগরী মুম্বাইতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৬০হাজার ছুঁই ছুঁই আর মৃত্যু মঙ্গলবার সকাল ৮টা অবধি ২২৫০জন। মুড়ি মুড়কির মতই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, মৃত্যুও বাড়ছে হু হু করে। আতঙ্কে ঘরবন্দি মানুষ, ভয়ে কেউ। প্রতিবেশীদের বাড়ি যায়না, আর কাউকে করোনা ছুঁলে তাকে হাসপাতাল পৌঁছনোর লোক মেলেনা। এমতাবস্থায় যে বাড়িতে দু’দুজনের করোনায় মৃত্যু হয়েছে তাঁদের পাশে কে দাঁড়াবে? তাই প্রায় নাবালক সুমন আর রৌনকের পাশে নেই কেউ। চেনা জগৎ বদলে গেছে হঠাৎ করেই, প্রতিবেশীরা জানিয়ে দিয়েছেন বাড়ির বাইরে বেরুনো যাবেনা।
অজিতের দাদা তাপস পাড়ুই জানিয়েছেন,” যে ফ্ল্যাটে ওরা থাকে সেই ফ্ল্যাটের পরিচালন কমিটির পক্ষ থেকে তিনবেলা খাবার রেখে দিয়ে আসা হয় সিঁড়ির কাছে। তাই দিয়েই কোনও মতে বেঁচে আছে ছেলে দুটো। আমরাও যেতে পারছিনা ১১ই জুনের পর থেকে ১৪দিন পের না হলে, ওরাও বের হতে পারছেনা। কোটি টাকার দোকান বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। কর্মচারীরও দেখা করতে আসতে পারছেনা। শুধু ফোনেই কথা হচ্ছে, কথা আর হচ্ছে কোথায়, শুধুই কেঁদে যাচ্ছে দুই ভাই।”