নিজস্ব সংবাদদাতা: এ কাহিনী আড়াই হাজার বছরেরও আগের, ইতিহাসের পাতায় সে নগরীরও নাম ছিল শ্রাবস্তী। দূর্ভিক্ষ পীড়িত সে নগরীর শ্রেষ্ঠ ধনপতি দের দূর্ভিক্ষ মোচনের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন স্বয়ং বুদ্ধদেব। কিন্ত ধর্মপাল, জয়সেন, রত্নাকর আদি শ্রেষ্ঠরা জানিয়েছিলেন, দূর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি ইত্যাদিতে তাঁদেরও ঘরে ফসল শুন্য অন্তত যা আছে তা দিয়ে এতবড় জনপদের ক্ষুদা মেটানো তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। বুদ্ধদেব যদি তাঁদের প্রান চাইতেন তা বরং দেওয়া সম্ভব হয়। পরের ঘটনা রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন তাঁর নগরলক্ষী কবিতায়, শ্রাবস্তীর ক্ষুদা মেটানোর স্পর্ধা নিয়ে এগিয়ে এলেন এক প্রায় ভিক্ষুনি সুপ্রিয়া। কী ভাবে এই ভিক্ষুনি সারা নগরের ক্ষুদা নিবারন করবেন এই প্রশ্নের উত্তরে বিনীতা জানিয়েছিলেন, ”আমার ভান্ডার আছে ভরে, তোমা সবাকার ঘরে। তোমরা চাহিলে সবে, এ পাত্র অক্ষয় হবে, ভিক্ষা অন্নে বাঁচাব বসুধা…”
সেদিনের সেই শ্রাবস্তী নগরী যদি আজকের করোনা তাড়িত বিশ্ব হয় তবে আজকের মেদিনীপুরের নগরলক্ষী নিশ্চিত ভাবেই শ্রাবস্তী মাইতি ও তাঁর বন্ধুরা। মেদিনীপুরের শ্রাবস্তীর বেড়ে ওঠা মহাতাপপুরে । প্রথম পাঠ মিশন গার্লসে নেওয়ার পর উচ্চশিক্ষার পর দিল্লিতে নিজের ব্যাবসা সামলান। লকডাউনে নিজের শহরে থাকার সময়েই তাঁর ভাবনায় চলে আসে মেদিনীপুর শহর ও শহর লাগোয়া গ্রামীন মেদিনীপুরের দুঃস্থ পরিবারগুলির পাশে দাঁড়ানোর কথা। কিন্ত একা কতটা করা যায়? তাই তিনি শ্রাবস্তী নগরীর ভিক্ষুনি অনাথপিণ্ডদ সূতা সুপ্রিয়ার পথই অবলম্বন করলেন। নিজের কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আবেদন জানালেন সাহায্যের। আবেদনে সাড়াও মিলল। নিজের ও বন্ধুদের অর্থের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া সাড়াকে অবলম্বন করে নেমে পড়লেন ত্রানে। এখনও অবধি সেই ত্রান পৌঁছে গেছে প্রায় ১০০০পরিবারে।
ত্রান বিতরনেও ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন শ্রাবস্তী ও তাঁর বন্ধুরা। গন ত্রানের পথ না ধরে একদম বেছে নেওয়া হয়েছে প্রকৃত দুঃস্থ পরিবার গুলিকে। আর তার জন্য নিজেদের সার্ভে করার পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়েছে সরকারি পরিসংখ্যানকে। যে পরিসংখ্যান দিয়ে সাহায্য করেছেন মেদিনীপুরের মহকুমা শাসক দীননারায়ন ঘোষ। শ্রাবস্তী বলেন, ” আমরা দুটো বিষয়ে জোর দিয়েছি। প্রথমত যাঁরা আমাদের সাহায্য করেছেন তাঁদের একটিও টাকাও যেন অপাত্রে না দান করা হয় আর যত কম অপাত্রে দান করা হবে ততবেশি প্রকৃত মানুষকে আমরা সাহায্য করতে পারব। তাই ঠিক কোন কোন পরিবার বা ব্যক্তিকে আমরা দান করব তা খুঁজে বের করা আমাদের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জের ছিল। আর এই কাজটা অনেকটাই সহজ করে দিয়েছেন মাননীয় মহকুমা শাসক।”
শ্রাবস্তীর বন্ধুরা সুতনু দাস অধিকারী, জয়দীপ জানা, সৌরভ পাল, সুদীপ্ত বাসু, শুভজিৎ মন্ডল,
জিতেন্দ্র সিং, শুভঙ্কর শেঠ, গৌরব হাতি নিজেরা তালিকা ধরে ধরে দান প্রাপ্ত পরিবারগুলি আগে থেকে নিজেরা খুঁটিয়ে সার্ভে করেছেন। কোনও রাজনৈতিক দল বা অন্য কোনও কারও কাছ থেকে নাম সংগ্রহ করেননি। খুঁটিয়ে এবং সরকারি তালিকা মিলিয়ে দেখে নিয়েছেন এবং কোনও রকম সরকারি সাহায্য পেয়ে(খাদ্য ও অর্থ ) থাকেন এমন পরিবারগুলিকে বাদ দিয়েছেন। এরপর দরজায় কড়া নেড়ে দরজার গোড়ায় ত্রান রেখে চলে এসেছেন। গ্রহিতা তাঁদের মুখ দেখতে পাননি।
শ্রাবস্তীর বন্ধুরা জানিয়েছেন, ” কোনও মানুষ যেন কোনও দিন আমাদের দেখে হীনমন্যতা আর কুণ্ঠা বোধ না করেন তাই আমরা মুখ দেখাই না কারন দুর্যোগ কেটে গেলে তিনি আবার মাথা তুলে দাঁড়াবেন। আজকের বিপর্যয় আর অসহায়তার স্মৃতি যেন আমাদের দেখে ফিরে না আসে তাই এই পথ বেছে নেওয়া।”
খাদ্য সামগ্রী সহ নিত্য প্রয়োজনীয় মোট ১৬টি দ্রব্য তুলে দেওয়া হচ্ছে পরিবারগুলিকে। হ্যাঁ, তার মধ্যে চা বিস্কুটও রয়েছে। বিপাকে পড়লে বাঙালি চা খাবেনা এমনটা হয়?