নিজস্ব সংবাদদাতা: করোনার কাঁটা এবার জামাইষষ্টিতেও। রীতিমত ঢেড়া পিটিয়ে গ্রামের সমস্ত পরিবারেই এবছর জামাইষষ্টি পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ীর নছিপুর গ্রামপঞ্চায়েতের ডাডরা গ্রামের বাসিন্দারা। মঙ্গলবার গ্রামের বারোয়ারি মন্ডপে বসে ২৫০ জনের উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে করোনা কালীন পরিস্থিতিতে গ্রামের কোনও পরিবারেরই এবার জামাই ষষ্টির পার্বন পালিত হবেনা। এবিষয়ে যে সমস্ত পরিবারে জামাই রয়েছে তাঁরা এ বছর জামাইদের জানিয়ে দেয় যে এবার যেন জামাইরা না আসেন। পাশাপাশি গ্রামের বিবাহিতদেরও একই ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে তারাও যেন শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার নামটি না ধরে। এই একই আদেশ জারি হয়েছে ডাডরার পড়শি গ্রাম ডম্বুরকোলাতেও। সব মিলিয়ে দুটি গ্রামের প্রায় ৩০০ পরিবার এবার জামাইষষ্টি পালন করছেনা বলেই জানিয়ে দিয়েছে।
বুধবারই ডাডরা গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম মুড়া থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছিল ঘোষককে। পেশাদার ঘোষক দুটি গ্রামের ৩বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রীতিমত ঢেড়া পিটিয়ে গলা ফুলিয়ে সেই ঘোষনা করে দিয়েছেন। ফলে বৃহস্পতিবার কার্যত আর পাঁচটা দিনের মতই স্বাভাবিকই কেটেছে গ্রামের পরিবেশ। গ্রামের বটতলায় পেল্লাই পেল্লাই খাসি ঝুলিয়ে কাটা হয়নি, আম কাঁঠালের গন্ধ নেই, শালীদের খিলখিল হাসি আর শ্বাশুড়ির শঙ্খ ধ্বনি শোনেনি ডাডরা আর ডম্বুরকোলা গ্রাম। গ্রামের নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্য কাঞ্চন ঘোষ জানিয়েছেন, ” বর্তমান পরিস্থিতির ওপর দাঁড়িয়ে গ্রামের মান্য গণ্য ব্যক্তিরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যাতে সম্মতি প্রকাশ করেছে পুরো গ্রাম। আমরাও মনে করছি এটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। উৎসব আসবে যাবে আপাতত মানুষ নীরোগ থাকুক।”
গ্রামের বর্ষীয়ান মানুষ মন্টু পালুই, রাসবিহারী ঘোষ, হারাধন পালুই, রমনী বেরারা জানিয়েছেন,” গ্রামের জামাইদের কেউ কলকাতা, কেউ ঝাড়গ্রাম কেউ পূর্ব মেদিনীপুরের বাসিন্দা। ঠিক তেমনই আমাদের গ্রামের ছেলেরাও বিভিন্ন জায়গায় বিয়ে করেছে। কোথায় কে যাবে আর কে আসবে, সে কোথায় কার সংস্পর্ষে এসেছে বা আসবে আমরা কী জানতে পারব বলুন? এবার তাই জামাই ষষ্টিটা বাদই দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করছি এতে শুধু গ্রামের নয়, জামাইদেরও মঙ্গল হবে আর জামাই ষষ্টিতো জামাইদের মঙ্গলেরই জন্য।”
ডাডরা গ্রামের এই ভাবনার পেছনে অবশ্য অন্য একটি ঘটনাও কাজ করেছে। চারদিন আগেই রাতে গ্রামে প্রবেশ করেছেন কলকাতায় কর্মরত গ্রামেরই এক বাসিন্দা। পরের দিন গ্রামের লোকেরা বিষয়টি জানতে পেরে তার বাড়িতে গিয়ে বলে এসেছে যে ওই পরিবারের সদস্যরা যেন বাড়ি থেকে বের না হয়। তাদের যাবতীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্য গ্রামবাসীরাই বাড়িতে পৌঁছে। দেবে। বৃহস্পতিবার অর্থাৎ জামাই ষষ্টির দিনই মহারাষ্ট্র থেকে ফিরছে। তাঁদের অবশ্য কোয়ারেন্টাইন করা হচ্ছে নছিপুর হাই স্কুলে। এই পরিস্থিতে কিছুটা উদ্বেগও রয়েছে গ্রামে। সেই জায়গা থেকেই সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা হিসাবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই গ্রাম।
যদিও তবুও মন খারাপ গ্রামের এক ঘোষ পরিবারে। বছর গড়ায়নি মেয়ের বিয়ের। এবছরই প্রথম জামাইষষ্টিতে আসার কথা ছিল। শ্বশুরবাড়িও এমন কিছু দূরে নয়। লকডাউনের নিষেধাজ্ঞা কিছুটা হলেও হালকা হয়েছে তাই ২৫ কিলোমিটার রাস্তা বাইক চালিয়েই মেয়েকে নিয়ে আসার কথা ছিল। গতকালই ফোন করে মেয়ে জামাইকে আসতে না বলে দিতে হয়েছে। অবশ্য মন খারাপ করতে না বলা হয়েছে। মেয়েকে ফোনে মা জানিয়ে দিয়েছেন, চিন্তা করতে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই অকাল জামাই ষষ্টি করে পাওনা গন্ডা মিটিয়ে দেবেন। সব মাসেই একটা ষষ্টি থাকে আর ষষ্টি মানেই সন্তানের কল্যানে ব্রত আর জামাই তো ছেলের মত। ঘোষ গিন্নির এই বেহিসেবিপনায় ক্ষুণ্ন ঘোষ মশাই। বললেন, ‘”আরে মশাই জামাইষষ্টি তো বছর বছর থাকবেই। বেশ একটা সুযোগ পাওয়া গেছিল বুঝলেন, মানে দোলের পর থেকেই দফায় দফায় ঝড়বৃষ্টি তার ওপর আমফান। সেভাবে চাষ হয়নি। ভেবেছিলাম কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে যাবে কিন্তু ওই যে যাকে বলে মেয়েদের বুদ্ধি, বেমক্কা কমিট করে বসে থাকল।”
অন্যদিকে একটু বেগড়বাঁই করেছিল গ্রামের নব্য বিবাহিত যুবক। ভেবেছিল ফাঁক তালে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। গ্রামের লোকেরা খবর পেয়ে জানিয়ে দিয়েছে, ” যেতে চাও যাও, কিন্তু ফেরার সময় ওই নছিপুর গ্রামের স্কুলে ১৪দিন কোয়ারেন্টাইন কাটিয়ে তবে গ্রামে ঢুকতে পারবে। জামাইয়ের জন্য এক নিয়ম আর গ্রামের ছেলেদের জন্য অন্য নিয়ম এটা ডাডরা গ্রাম এই একচোখামি করবেনা।”