চিন্ময় দাশ
রাধাবিনোদ মন্দির, বড়িষা (পিংলা)
গুরুদেবকে প্রণামী দিতে এককালে কত কিছুই না করতেন রাজা জমিদারেরা। চন্দ্রকোনার রাজা আস্ত একটা জমিদারি অধিকার করে, কুলগুরুকে প্রণামী দিয়েছিলেন। জমিদারিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কেশপুর থানার আঢ়রাগড়ে। যে আঢ়রাগড়ে বসে চন্ডীমঙ্গল লিখেছিলেন কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম।পরে সেই জমিদারি ব্রাহ্মণভূম পরগণা নামে খ্যাত হয়েছিল।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
আমরা এখানে বলব আরও এক রাজার কাহিনী। সেই রাজা তাঁর পুরো একটি পরগনার রাজস্ব তুলে দিতেন কুলগুরুর হাতে, প্রণামী হিসেবে। একটি মন্দিরও গড়ে দেওয়া হয়েছিল গুরুদেবের জন্য। আজ আমাদের কথকথা জীর্ণ হয়ে পড়া সেই মন্দির নিয়ে।
মেদিনীপুর জেলার একেবারে দক্ষিণে ছিল হিজলী পরগনা। পাঠান রাজত্বকালে জেলার একমাত্র মুসলমান জমিদার তাজ খাঁ ‘মসনদ-ই-আলা’র রাজত্ব ছিল সেটা। তাজ খাঁর বংশ পতনের পর, তিনটি অংশে ভাগ হয়ে যায় রাজ্যটি– জলামুঠা, মাজনামুঠা এবং সুজামুঠা। তাজ খাঁর দরবারেরই দুই কর্মী–ঈশ্বরী পট্টনায়েক আর ভীম সিংহ– প্রথম দুটি অংশ পেয়েছিলেন। সুজামুঠায় জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন জনৈক গোবর্ধন রণঝাঁপ।
গোবর্ধনের পর, ক্রমান্বয়ে রাজা হয়েছেন মাধবচন্দ্র, শ্রীধর নারায়ণ, গোপাল নারায়ন, গোরাচাঁদ। পঞ্চম রাজা গোরাচাঁদ তিন নাবালক পুত্র রেখে মারা যান, তখন তাঁর রানী ক্ষমতায় আসেন। এই রানীই কাজলাগড়কে সুজামুঠার রাজধানী ঘোষণা করেছিলেন। এর পরে চারজন রাজা হয়েছেন– রাজেন্দ্র নারায়ণ, গজেন্দ্র নারায়ণ, মহেন্দ্র নারায়ণ এবং মহেন্দ্রর পুত্র দেবেন্দ্র নারায়ণ।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
এটি হল জমিদার বা রাজার কাহিনী। এবার তাঁদের গুরুবংশের কথা সামান্য জেনে নেওয়া যাক।
কেলেঘাই নদীর উত্তরে বড়িষা গ্রাম। সেখানে বহুকাল যাবৎ ভট্টাচার্য্য পদবীর এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারের বাস ছিল। তাঁরা ছিলেন সুজামুঠা জমিদারদের গুরুবংশ। জমিদারদের একটি মহাল ছিল ভূঁঞামুঠা পরগণা। এই পরগণার ‘ বুটি ‘ (রাজস্ব বা খাজনা) আদায়ের ভার দেওয়া ছিল গুরুবংশের হাতে। পুরো পরগণার ‘ বুটি ‘ সংগ্ৰহ করে বছর শেষে দরবারে জমা দিতে কাজলাগড় যেতেন গুরু। তখন জমিদার সেই টাকা পুঁটলি শুদ্ধ নামিয়ে দিতেন গুরুদেবের চরণে। বছর বছর এটিই ছিল গুরুবংশের প্রণামী।
জমিদারদের ভিতর মহেন্দ্র নারায়ণ ও দেবেন্দ্র নারায়ণ– পিতা-পুত্র দেব এবং দ্বিজে সমান ভক্তিপরায়ণ ছিলেন।তাঁরা কুলগুরুর বংশের পূজার্চনার জন্য, একটি মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। বড়িষা গ্রামেই (বর্তমান পিংলা থানা) নির্মিত হয়েছিল মন্দিরটি। ১৮০৭ সালে দেবেন্দ্র নারায়ণ প্রয়াত হন। সেই হিসাবে বলা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
মন্দিরটি রত্নরীতির পঞ্চ-রত্ন হিসাবে নির্মিত। ইটের তৈরী, দক্ষিণমুখী। পাদপীঠের অনেকটাই বর্তমানে ভূমিগত। প্রদক্ষিণ-পথটিও জীর্ণ। জীর্ণতার ছাপ মন্দিরের সর্বাঙ্গ জুড়ে। রত্নগুলি অক্ষত নাই, খসে খসে পড়ছে। খসে পড়ছে টেরাকোটা ফলকগুলিও। সংস্কার করবেন, সেই সাধ্য আর নাই গুরুবংশের।
বর্ধমানের মহারানী নারায়ণ কুমারী দেবী যেদিন নিলামে পুরো সুজামুঠা জমিদারিটিই কিনে নিয়েছিলেন, তখন থেকে গুরুবংশের সংকটের সূচনা।মন্দিরে জীর্ণতার গ্রাসও সূচিত হয় তখন থেকেই।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
যাইহোক, মন্দিরে ইমারতি থাম আর দরুণ-রীতির খিলান দিয়ে তিনটি দ্বার যুক্ত একটি অলিন্দ। গর্ভগৃহে প্রবেশের একটিই দ্বার।পশ্চিম দিকেও অনুরূপ অলিন্দ রচিত আছে। রত্ন বা চূড়াগুলিতে শিখর রীতির রথ-বিভাজন করা। পাঁচটি চুড়াতেই পঞ্চ-রথ বিন্যাস। রত্নের শীর্ষক অংশে বেঁকি, আমলক , কলস, চক্র– কিছুই অবশিষ্ট নাই আজ আর, কিছুই।
গর্ভগৃহের মাথার ছাউনি চালা-রীতির। তবে জোড়মুখগুলি হস্তীপৃষ্ঠের মত উত্তল নয়, বিষ্ণুপুরী চাল এখানে। রত্নগুলির ছাউনিও চালা -রীতির।
সামনের দেওয়ালে কার্নিশের নিচে একটি সারিতে বিষ্ণুর দশ অবতারের মূর্তি দিয়ে মন্দির অলংকৃত। মূর্তিগুলি টেরাকোটা এবং বেশ বড় আকারের। গর্ভগৃহে দক্ষিণের দ্বারপথের দুপাশে দুটি দ্বারপাল এবং পশ্চিমের দ্বারপথের গায়ে দুটি দ্বারপালিকা। কয়েকটি মিথুন ফলকও আছে মন্দিরে।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
এই মন্দিরের ইতিহাস আছে, ঐতিহ্য আছে, আছে টেরাকোটা অলংকরণও।যা নাই, তা হল মন্দিরের আয়ু। সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ার দিন গুনছে দেবালয়টি। সেদিনের বেশি দেরি নাই আর।
যাওয়া-আসা– মেদিনীপুর শহর, ডেবরা কিংবা বালিচক স্টেশন থেকে ময়না গামী বাস রাস্তায় জলচক। সেখানে নেমে সামান্য উত্তরে বড়িশা গ্রাম এবং ভট্টাচার্য্য পরিবারের বসতবাটি সহ মন্দিরটি অবস্থিত।
প্রচ্ছদ-রামকৃষ্ণ দাস