অশ্লেষা চৌধুরী: হাউমাউ করে কাঁদছেন বরন্তির ভূষণ মাহাত। বলছেন, ‘ওদের কান্না শুনতে পাচ্ছি। বন্য শুকর তীব্র আর্তনাদে ছোটাছুটি করছে, তার ছোট ছোট আট-দশটি ছানা। ওরা এখনো মায়ের দুধ ছাড়েনি। কোথায় পালাবে ওরা? ভুটরা শেয়াল, লোমশ নেউল, মেটে খরগোশ সবাই কাঁদছে। ওদের বাঁচান দয়া করে বাবুরা। আপনাদের যে অনেক ক্ষমতা, অনেক যন্ত্রপাতি, দমকল!” জ্বলছে সেই বরন্তি যেখানে শুধু আগুন রাঙা পলাশ দেখতে ছুটে আসেন কলকাতা, মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, দুর্গাপুরের পলাশ প্রিয় পর্যটকের দল।
বছর ষাটেকর ভূষণ, অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁর দু’গাল বেয়ে নামছে জল। তাঁর কিছুই করার নেই, গোটা পাহাড় জ্বলছে, জ্বলছে জঙ্গল, জ্বলছে মানুষের লোভের আগুনে। শুধু বরন্তি নয়, জ্বলছে কংসাবতী-উত্তর বনবিভাগের রঘুনাথপুর রেঞ্জের গড় পঞ্চকোট, দণ্ডহিত থেকে জয়চণ্ডী পাহাড়।
ওদিকে দাউ দাউ আগুনের কবলে পুরুলিয়ার বলরামপুর, আড়শা, কোটশিলা, ঝালদা, অযোধ্যা, বাঘমুন্ডি রেঞ্জের অযোধ্যা পাহাড় থেকে মাঠা, কংসাবতী-দক্ষিণ বন বিভাগের বন্দোয়ানের লোটো ঝরনা, নান্না। এ আগুন নেভানো অসম্ভব কারন বনকর্মীদের কাছে আগুন নেভানোর মত কোনও সরঞ্জাম নেই। দু’দশটা দমকলের ইঞ্জিন এ আগুন নেভাতে পারবে না। হয়ত দক্ষিণ বঙ্গের সমস্ত ইঞ্জিন এনেও এ আগুন নেভানো যাবে না। জ্বলছে হাজার হাজার হেক্টর। কাঁচা গাছের ডালপালা দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে নাজেহাল বনকর্মীরা। এ পাশে নেভালে ওপাশে জ্বলে ওঠে।
দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে শুশুনিয়া পাহাড়ে বিধ্বংসী আগুন লেগে আসছে। গত এপ্রিলেও শুশুনিয়া পাহাড়ের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে আগুন লেগেছিল। ফের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আগুন লেগেছে বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড়ের জঙ্গলে। তিন দিন ধরে দাউ দাউ করে জ্বলছে পাহাড়। আগুনের তাপে জঙ্গলের অনেক মূল্যবান গাছপালা ঝলসে যাচ্ছে। এমনকি সাপ, খরগোশ ছাড়াও অন্যান্য বন্য প্রাণী শুশুনিয়া পাহাড়ে প্রায় বিলুপ্তির পথে। স্থানীয় দুষ্কৃতিদের একাংশই জঙ্গলে আগুন লাগিয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছে বন দফতর। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার সচেতন করা হলেও, বন্ধ হয়নি পাহাড়ে আগুন লাগানোর ঘটনা। জঙ্গলে আগুন লাগানোর না আবেদন জানিয়ে প্রচার শুরু করেছিল পুরুলিয়া বন বিভাগও। নেট থেকে মাইক সবরকম প্রচার চালানো হয় কিন্তু মানুষ বলে কথা! কেন শুনবেন তারা সেসব! তাই তো তাদের একাংশের কিছুটা অসচেতনতা, কিছুটা গাফিলতি, কিছুটা একঘুয়েমির পরিণাম ভুগতে হচ্ছে অসহায় এই বন্য প্রানগুলিকে।
কল্যাণ কুমার কুণ্ডু বলে একজন অবশ্য এর জন্য প্রশাসনকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ীর ঠিক পিছনে হিল ভিউ গ্রাউন্ড। দূরে দক্ষিণ পশ্চিমে অযোধ্যা পাহার শ্রেণী স্পষ্ট দেখা যায়। ছোটবেলাতেও দেখেছি পাহাড় জ্বলছে। আজও দেখি তাই। মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, প্রশাসন ও রাজনৈতিক মদত না থাকলে বছরের পর বছর এই সময় এই বহ্নিলীলা সংঘটিত হয় না। প্রশাসনে যারা আছেন, তাদের জেলার প্রতি কোন আবেগ নেই, মস্তিষ্ক ও মেরুদন্ড বন্ধক রাখা। আর পুরুলিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্বের কথা যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল। জেলার মানুষ এগিয়ে আসুন। আপনাদের সুপ্ত বিবেককে জাগ্রত করুন। এছাড়া ভরসা পাচ্ছি না।’ পুরুলিয়ার এক বাসিন্দা সাইক্লিস্ট অক্ষয় ভগত, এর জন্য অসাধু স্বার্থান্বেষী মানুষদেরই দায়ী করেছেন। তিনি জানান, ‘এ কোনও দাবানল নয়, দাবানলের সময় আসেনি। মনুষ্য সৃষ্ট কিছু অসাধু স্বার্থান্বেষী মানুষের লালশার শিকার আমাদের অযোধ্যা। এভাবেই পাহাড়ের ঔষধি, ছোট বড় বিভিন্ন প্রজাতির প্রানী , পশু পাখি ,কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদরাজি তথা ইকোসিস্টেম ধ্বংসের সাথে আমাদের সমূহ বিপদ এগিয়ে আসছে।’
তবে, পাহাড়ে আগুন লাগার ঘটনা নজরে পড়তেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে বন দফতরের কর্মীরা সহ স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। সাথ দিয়েছে গ্রামবাসী ও সিভিক ভলেন্টিয়ার রাও। ঝাঁটিপাহাড়ি রেঞ্জার অফিসারকে আগুন লাগার কারণ জানতে চাইলে বলেন, আমাদের ডিপার্টমেন্টের স্টাফ ও বন দফতরের কর্মীরা মিলে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে খুব শীঘ্রই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসবে। বিট বাবু বলেন, পাহাড়ি এলাকা চাই কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে খুব শীঘ্রই আগুন নিভে যাবে। শুশুনিয়া পাহাড়ের ঝরনা তলার এক প্রস্তর শিল্পী কানু কর্মকার বলেন, শুশুনিয়া পাহাড়ে আগুন লাগার ঘটনা খবর পেলেই বাঁকুড়া থেকে একটি দল এসে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে এবং প্রায় সারা বছর ধরেই বেশকিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ছেলেমেয়ে পাহাড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পেছনে সচেতন।’ গতবারে যেভাবে গ্রামের ছেলেরা পাহাড়ে আগুন নিভিয়ে ছিল ঠিক সেভাবেই রাতের অন্ধকারের মধ্যেও ঝাঁপিয়ে পড়েছে। খুব শীঘ্রই আগুন নিভবে বলে আশাবাদী তারা।