তিতলী সেনগুপ্ত : রবিবার অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই শোকস্তব্ধ গোটা দেশ। সরকারীভাবে সুশান্তের মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলা হয়েছে কিন্তু সুশান্তের পরিবারের তরফে বারংবার দাবি করা হচ্ছে এটা ‘আত্মহত্যা’ নয় ‘খুন’ করা হয়েছে সুশান্তকে। যদিও খুন যে শুধু শারীরিকভাবে হয় তা কিন্তু নয় খুন মানসিকভাবেও হতে পারে, অন্তত সুশান্তের মৃত্যুর পর বলিউডের বেশ কিছু মানুষের কথা থেকে তাই মনে হচ্ছে। মৃত্যুর আগের রাতে চরম মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছেন সুশান্ত৷ কিন্তু কেন? সূত্র বলছে, লকডাউনের পর থেকে সুশান্তের বাড়িতেই ছিলেন তার বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তী। মৃত্যুর আগের দিন অর্থাৎ শনিবার রাতে আচমকা রিয়াকে নিজের বাড়ি ফিরে যেতে বলে সুশান্ত। হয়তো তাদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। সুশান্তের কথা অনুযায়ী ফিরেও গিয়েছিল রিয়া। কিন্তু এতদিন পর ওইদিনই কেন রিয়াকে চলে যেতে বললো সুশান্ত? তবে কি সে মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছিল যে এবার সবার অগোচরে সবার থেকে দূরে চলে যেতে হবে। আর তার যাওয়ার পথে রিয়া বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে সেই কথা ভেবেই কি তবে রিয়াকে বাড়ি চলে যেতে বলেছিলেন সুশান্ত??
তবে সুশান্তের ফোন থেকে রাত ১টা ৪৭ মিনিট নাগাদ ফোন গিয়েছিল রিয়ার ফোনে, কিন্তু রিয়া ফোনটা তোলেনি। হয়তো ঘুমিয়ে ছিল কিংবা হয়তো অভিমানে সুশান্তের ফোনটা ধরতে চাননি রিয়া। কিন্তু যাকে বাড়িতে বের করে দিলেন তাকেই ফের মধ্যরাতে হঠাৎ ফোন করতে গেলেন কেন? তবে কি রিয়া চলে আসার পর সুশান্তকে একাকিত্ব আরও গ্রাস করছিল? রিয়াকে অবলম্বন করেই তো এতদিন বেঁচেছিল সুশান্ত। হয়তো তার মানসিক অবসাদের কথা বারবার বোঝাতে চাইতো রিয়াকে কিন্তু সে বুঝতে পারেনি। শেষরাতেও তেমন কিছু বলতেই হয়তো ফোন করেছিল কিংবা শেষবারের মতো একবার কথা বলতে চেয়েছিলেন রিয়ার সাথে। কিন্তু সুশান্তের শেষ ফোনটাও ধরতে পারলো না সে!!
সুশান্তের মৃত্যুর খবর চাউর হতেই বলিউডের তাবর তাবর সেলিব্রিটিরা যখন টুইট করে শোকপ্রকাশ করছেন সেই সময় হাজার টুইটের মাঝে কর্ণ জোহরের পোস্ট নজর কেড়েছিল সকলের। টুইটে সুশান্তের মৃত্যুর দায় তিনি নিজের কাঁধেও খানিক নিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ সুশান্তের মৃত্যুর দায় নিজের কাঁধে নিতে গেলেন কেন কর্ণ জোহর, কি কারণেই বা তাঁর অপরাধবোধ ? কর্ণের এমন অদ্ভুত পোস্টের উত্তর খুঁজতে যখন মরিয়া নেটিজেনরা, ঠিক সেই সময় সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে সোমবার দুপুরে ‘দাবাং’ পরিচালক শেখর কপূরের করা একটি টুইট অনেকটা রহস্যভেদ করতে সক্ষম করেছেন নেটিজেনদের। এদিন সুশান্তের উদ্দেশ্যে শেখর কপূর টুইটে লিখেছেন, ” আমি জানি, কাদের জন্য তোমার এই হতাশা, গত ছ’মাসে যদি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতাম… যা হয়েছে সেটা ওদের কর্মফল, তোমার নয়” কারো নাম না নিলেও শেখরের এই টুইট ঘিরে বলিউডের অন্দরের অনেক গোপন সত্যের ইঙ্গিত যে মেলেনি তা কিন্তু নয়।
শেখরের পর অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াতের ভিডিওতেও বেশ কিছু সত্যের ইঙ্গিত মেলে। একটি ভিডিয়োর মাধ্যমে কঙ্গনার বিস্ফোরক মন্তব্য করেন, তিনি বলেন, ‘‘বলিউডের ইতিহাস লিখতে যারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী, তারা দুর্বলচিত্ত হিসেবে সুশান্তকে দেখাতে চায়। ‘গাল্লি বয়’-এর মতো খারাপ ছবি পুরস্কৃত হয়। এ দিকে ‘ছিছোরে’র জন্য সুশান্তকে সম্মান দেওয়া হয়নি। তবে সুশান্তের ভুল, ওকে যারা প্ররোচিত করেছে, ও তাদের কথা মেনে নিয়েছে।’’
এদিকে দিনের পর দিন নিজের মনের দুঃখ-কষ্ট, ভয়-অভিমানগুলোকে নিজের মধ্যে চেপে রেখে কখন যে সেগুলি পাহাড় সমান হয়ে মানসিক ভাবে সুশান্তকে আস্তে আস্তে শেষ করে দিচ্ছিল তা আঁচই করতে পারেননি সুশান্তের পরিবার-বন্ধুবান্ধব এমনকি ‘প্রেমিকা’ রিয়াও। তাই হয়তো ৩রা জুন শেষবারের মতো মৃত মাকে মিস করে মায়ের সাথে ছবি পোস্ট করেছিলেন সুশান্ত। হয়তো মনে হয়েছিল মা বেঁচে থাকলে তাকে সব মনের কথা খুলে বলতেন সুশান্ত। কেরিয়ারে সাফল্য পেলেও, বলিউডের মতো ইন্ডাস্ট্রিতে ‘গডফাদার’ না থাকায় তাকে ক্রমশ কোণঠাসা করে দিচ্ছিলেন সকলে। জানা গিয়েছে, কেরিয়ারের শুরুর দিকে যশ রাজ ফিল্মসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকায় তাঁর হাতছাড়া হয়েছিল সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর ‘রামলীলা’। সঞ্জয় নিজেই নাকি ‘রামলীলা’য় সুশান্তকে নেওয়ার জন্য যশ রাজের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সুশান্ত যশের কাছে চুক্তিবদ্ধ থাকার অজুহাত দেখিয়ে সে সময় সুশান্তকে ছাড়েনি যশ রাজ৷ তবে একই সময় চুক্তিবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও রণবীর সিংহকে ছবিটি করার অনুমতি দিয়েছিলেন যশ রাজ ফিল্মস। বিষয়টি খারাপ লেগেছিল সুশান্তের কিন্তু চুপ করে সহ্য করেছিলেন তিনি৷ এরপর আদিত্য চোপড়ার পরিচালনায় ‘বেফিকরে’ ছবিটি করার কথা ছিল সুশান্তের। কিন্তু ছবির কাস্টিং হয়ে যাওয়ার পরেও সেটি ফের চলে যায় রণবীর সিংহের কাছে। এখানেও ফের আরেকবার ধাক্কা খেয়েছিল সুশান্ত৷ এই সময় কর্ণ জোহরের প্রযোজনায় সুশান্ত অভিনীত ‘ড্রাইভ’ নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায়। তবে ছবির ডিজিটাল রিলিজ প্রসঙ্গে সুশান্তকে কিছু না জানিয়েই বড় পর্দার ছবিটি নেটফ্লিক্সে রিলিজ করে কর্ণ। সেই সময় সুশান্তের সাথে অশান্তি হয় সুশান্তের। এর কিছুদিন পরেই যশ রাজ ফিল্মসের তরফে সুশান্তকে ‘পানি’ নামে একটি ছবি দেওয়া হয় যার পরিচালনা করার কথা ছিল শেখর কপূরের। কিন্তু বছর দুয়েক পরে প্রজেক্টটি বন্ধ করে দেয় যশ রাজ ফিল্মস। এমনকি গত দেড় বছরে কোনো ফিল্মিপার্টিতেই ডাকা হয়নি সুশান্তকে। এইভাবেই একের পর এক বহু ঘটনা সুশান্তের মনে দাগ কাটে৷ সে বুঝতে পারে ইন্ডাস্ট্রির একটা বৃহৎ অংশ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাকে কোন ঠাসা করার চেষ্টা করছে। ফলে এভাবেই ধীরে ধীরে ইন্ডাস্ট্রি থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার ভয় ও অভিমান সুশান্তকে মানসিক রোগী করে তোলে। এভাবেই একটা তরতাজা প্রাণবন্ত ছেলের প্রাণ নীরবে কেড়ে নিল বলিউড ইন্ডাস্ট্রির গোপন ‘ষড়যন্ত্র’।