বারহারওয়া জায়গাটি প্রথমে বিহারের মধ্যে ছিল। পরে ঝাড়খন্ড রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। বিহারের মধ্যে থাকার কারণে, এতদিন এখানকার স্পটগুলি পর্যটনস্থল হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি। উত্তর-পশ্চিমে বিস্তৃত রাজমহল পাহাড়শ্রেণীর নিচে সবুজে মোড়া উপত্যকা। সেই সমতল উপত্যকার বুক চিরে চলে গেছে রেলপথ। ছোট এক টিলার ওপর বিন্দুধাম তথা মাতা বিন্দুবাসিনীর মন্দির। এই মন্দিরটি থেকেই পাহাড়শ্রেণীর মনোরম সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যায়। মূল মন্দিরের উত্তর-পশ্চিম কোণে ২০০৭ সালে একটি ৩৬ ফুট উচ্চতার হনুমানজীর মূর্তি স্থাপিত হয়েছে। এই হনুমান চটী ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখা রাজমহল পাহাড়ের কোলে ঢলে পড়া সূর্যাস্ত, বহুকালের জন্য মনের মণিকোঠায় স্থান করে নেবে।
শিব পুরাণ অনুযায়ী, এই স্থানটি ৫১ শক্তিপীঠের এক পীঠ। এখানে পাহাড়ের ওপর দেবী সতীর তিন বিন্দু রক্ত পতিত হয়েছিল, তাই নাম বিন্দুবাসিনী। ১০৮টি সিঁড়ি পেরিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। সিঁড়িতে ওঠার মুখে প্রথমে প্রবেশ তোরণ। তার ঠিক বামদিকেই “অক্ষয় কূয়া”। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী, বহু বছর আগে একবার এই এলাকায় প্রবল খরা দেখা দেয়। পুকুর-নদী সব শুকিয়ে যায়। তখন এই মন্দিরের তন্ত্রসাধক পাহাড়ী বাবা, মায়ের নাম নিয়ে একটি বাতাসা এই কূয়াতে ফেলে দেন। তারপর থেকে ঐ কূয়ার জল সুপেয় হয়ে ওঠে এবং আজ পর্যন্ত কোনদিন এর জল শুকনো হয়নি। সিঁড়িপথের শেষে দ্বিতীয় প্রবেশ তোরণ।
তার ডানদিকে কল্পতরু বৃক্ষ ও দ্বারপাল হনুমান। ভক্তরা মনস্কামনা পূরণের জন্য এই গাছে লাল সুতো দিয়ে পাথর বেঁধে দেয়। দ্বিতীয় প্রবেশ তোরণ পেরোলেই দেখতে পাবেন শিল্পীর তৈরি অসাধারণ এক সূর্যরথ। এরপর আরো কয়েকটি সিঁড়ি পেরিয়ে মূল মন্দিরে প্রবেশ। এখানে কোন মূর্তি নেই। বামদিকে মহালক্ষী, মাঝে মহাদুর্গা এবং ডানদিকে মহাসরস্বতী শিলা-পিণ্ড রূপে বিরাজমান। ২০০৭ সালে তিনটি ফলকের ওপর রূপার প্রতিমা বানিয়ে শিলাগুলিকে ঢেকে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে রূপার ফলকগুলি চুরি হয়ে যায়।
তারপর থেকে সেই আগের অবস্থাতেই দর্শন হয়। মূল মন্দিরের পাশে আরো কয়েকটি মন্দির রয়েছে – সংকটমোচন হনুমান, শিব পঞ্চায়েত, বাসুদেব, মাতা যোগেশ্বরী এবং রাণীসতী। দক্ষিণ দিকে বিবাহ মন্ডপ ও যজ্ঞ কুন্ড আছে। এই মন্দিরে প্রতি বছর চৈত্রমাসের শুক্লা পঞ্চমী থেকে রামনবমী পর্যন্ত “শত চন্ডী যজ্ঞ” অনুষ্ঠিত হয়। মন্দিরের পাদদেশে একমাস ব্যাপী মেলা বসে। বাংলা, ঝাড়খন্ড ও ওড়িশার হাজার হাজার মানুষ এই উৎসবে সামিল হন।
মহাবতার বাবা হিমালয়ে তপস্যা করতেন। কথিত, তিনি আদি শংকর এবং কবীরকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনা গড়ে তোলার গুরু দায়িত্ব দেন বাঙালী শিষ্য শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়কে। ১৮৬৮ সালে কুমায়ুনের রানিক্ষেতে ব্রিটিশ সরকারের সামরিক পূর্ত দফতরের কেরানি শ্যামাচরণ লাহিড়ীর সঙ্গে মহাবতার বাবার যোগাযোগ কিভাবে হয়, সে এক আশ্চর্য প্রচলিত গল্প। সেটা আর এখানে বললাম না। হুগলীর রাজহাটে লাহিড়ী বাবার আশ্রম আছে। লাহিড়ী মহাশয়ের দুই শিষ্য ছিলেন – যুক্তেশ্বর গিরি ও সত্যানন্দ গিরি। যুক্তেশ্বর গিরির শিষ্য পরমহংস যোগানন্দ (আসল নাম মুকুন্দচরণ ঘোষ, ১৮৯৩ – ১৯৫২))।
তিনি “যোগী কথামৃত” (Autobiography of a Yogi) গ্রন্থ রচনা করেন। অন্যদিকে সত্যানন্দ গিরির শিষ্য হলেন পাহাড়ী বাবা, যাঁর আসল নাম উপানন্দ গিরি। পাহাড়ী বাবা ক্রিয়াযোগ দীক্ষা নেন সত্যানন্দ গিরির কাছে এবং তন্ত্র শিক্ষা লাভ করেন শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণবের কাছে। তিনি প্রথম এই পাহাড়ে শক্তিপীঠের অস্তিত্ব অনুভব করেন। এখানে একটি বটবৃক্ষের তলায় ধূনী জ্বালিয়ে যোগ ও তন্ত্র সাধনা করতেন। ১৯৬০ – ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে ছিলেন। এখানে মন্দির বানান। সেসময় এখানে মানুষজন মানত করে ছাগ বলি দিতে আসত। পাহাড়ী বাবা একদিন তাদেরকে বলেন, “বলি বন্ধ কর, তোমাদের যদি মনে হয় এতে পাপ হবে, সে পাপ আমি নিজের ওপর নিলাম”।
তারপর থেকে এই মন্দিরে বলি বন্ধ হয়ে যায়। বারহারওয়াতে ১৯৬৭ সালে খরা-মহামারী এবং ১৯৭১ সালের বন্যা দূর্গতদের সেবামূলক কাজে পাহাড়ী বাবার অশেষ অবদান রয়েছে। এছাড়া একবার তিনি ঝাড়গ্রামের একটি আশ্রমে থেকে ঐ এলাকার বন্যা দূর্গতদের সাহায্য করেন। এই সেবাকার্যের কথা শুনে জওহরলাল নেহেরু তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
এইভাবে বার বছর বিন্দুবাসিনী মন্দিরে থাকার পর, হঠাৎ ১৯৭২ সালে একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যান। দু’বছর পর তাঁকে রাজস্থানের জয়পুরে দেখতে পাওয়া যায়। সেখানেই ১৯৭৬ সালে তিনি দেহত্যাগ করেন। হরিদ্বারের গঙ্গায় তাঁকে জল-সমাধি দেওয়া হয়। পাহাড়ী বাবার তিন শিষ্যের মধ্যে নিবারণ বাবা, গঙ্গা বাবা এবং কমলবাবা (বর্তমানে প্রয়াত) এই মন্দিরে থাকেন।
◆ মন্দিরের সম্পর্কে আরো কিছু জানতে, যোগাযোগ – 9162013479 (গঙ্গা বাবা), 9431948071 (অধ্যক্ষ)।
◆ পরমহংস যোগানন্দের লেখা “যোগী কথামৃত” বাংলা বইটি অনলাইনে কিনতে পারেন।
◆ উত্তরাখন্ডের রাণীক্ষেত থেকে ৪৬ কিমি দূরে কুকছিনা নামক স্থানে ‘বাবাজী কা গুহা’ রয়েছে এবং সেখানে ক্রিয়াযোগ চর্চাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। দক্ষিণী তারকা রজনীকান্ত ঘুরে গিয়ে, বাবাজি কা গুহা নিয়ে চলচ্চিত্রও তৈরি করেছেন।
◆ কিভাবে যাবেন :-
নিকটবর্তী রেলস্টেশন বারহারওয়া (ঝাড়খন্ড)। হাওড়া থেকে রেলপথে দূরত্ব ৩০০ কিমি। হাওড়া থেকে রাতের জামালপুর এক্সপ্রেস, শিয়ালদহ থেকে বারণসী এক্সপ্রেস অথবা আনন্দবিহার এক্সপ্রেসে চড়ে ভোরবেলায় পৌঁছান যায়। বারহারওয়া স্টেশন থেকে অটোতে ৩ কিমি দূরে মন্দির।
◆ কোথায় থাকবেন :-
মন্দির চত্বরে দর্শনার্থীদের থাকার জন্য মন্দির কমিটির গেস্ট হাউস “যাত্রিক” নির্মানের পর কোন অজানা কারনে আজও তালা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। বারহারওয়া স্টেশনে থাকার অনেক লজ-হোটেল আছে।
◆ কোথায় খাবেন :-
মেলার সময় ছাড়া, মন্দিরের পেছনের দিকে মানিকদার চা নাস্তার দোকানটি একমাত্র ভরসা। বারহারওয়া স্টেশনে অনেক খাওয়ার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট আছে।
◆ আশেপাশে কি কি দেখবেন :-
বারহারওয়া স্টেশন থেকে ২৫ কিমি দূরে গজেশ্বরনাথধাম বা শিবগাডি অবশ্যই ঘুরে আসবেন। এখান থেকে আরো দুদিন সময় হাতে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন- ঊধয়া পাখিরালয়, রাজমহল, বারদ্বারি, জামি মসজিদ, কাঠঘর গ্রাম, কানাইয়া স্থান, মোতি ঝরণা ইত্যাদি।