ভবানী গিরি: সুব্রত মহাপাত্রের ভাবনাটা বদলে গেছিল কয়েক বছর আগে যখন এক প্রাক্তন ছাত্র তাঁর কাছে এসে কেঁদে ফেলেছিল। সেই অসহায় ছাত্রটি নিজের প্রাক্তন শিক্ষকের কাছে অসহায় ভাবে জানিয়েছিল যে তাঁর শিশুপুত্রটি থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। সুব্রত মহাপাত্র জানালেন, ‘সেদিন আমার মনে হল শুধু পড়াশুনা শেখানোই একজনের শিক্ষকের কাজ নয়। লেখাপড়ার পাশাপাশি একজন শিক্ষক পড়ুয়াদের জীবন চর্যা শেখাতে না পারলে তাঁদের জীবনের অনেক কিছুই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।”
জঙ্গলমহলের ঝাড়গ্ৰাম জেলার গোপীবল্লভপুর ২ ব্লকের বেলিয়াবেড়া কৃষ্ণ চন্দ্র মেমোরিয়াল উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক সুব্রত মহাপাত্র জানালেন,”দেখুন সামান্য একটু সচেতনতাই এই সমস্যা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে। আমরা জানি বাবা এবং মা দুজনেই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয় তাহলে তাঁদের সন্তান কখনও থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হতে পারেনা। অর্থাৎ আমাদের কাজ হল দুটি মানুষ অর্থাৎ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছেন এমন দুজন নারী পুরুষের দুজনেই যাতে থ্যালাসেমিয়া বাহক না হন এটা নিশ্চিত করতে হবে। যদি কোনও একজন বাহক হন তাতে কোনও সমস্যা নেই অর্থাৎ সেক্ষেত্রে বিয়ের কোনও অসুবিধা নেই।”
হ্যাঁ, জঙ্গল মহলের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে এই সচেতনতার প্রচার করছেন সুব্রত মহাপাত্র। স্কুল ছুটির পর একজন ছাত্রের সাইকেল নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মানুষজন দের বোঝাচ্ছেন কেন বিয়ের আগে “থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা ” করা উচিত। এই সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সুব্রত বাবু তিন দিন স্কুলের একটা রুমে থেকে যান। এই ক’দিন তিনি তাঁর মেদিনীপুর শহরের বাড়ি ফেরেননা। এই কাজের জন্য সুব্রত বাবু নিজের খরচে পাঁচ হাজার পোষ্টার ছাপিয়েছেন এবং নিজেই আঠার ব্যাগ ও পোষ্টার নিয়ে বিবাহ যোগ্য ছেলে বা মেয়ে আছে এমন বাড়িতে গিয়ে শেখাচ্ছেন যে বিয়ের পিড়িতে বসার আগে কুষ্ঠি বা ঠিকুজি বিচারের চাইতেও জরুরি থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করা।
এই কাজটি আগে তিনি তাঁর স্কুলে প্রতি বছর এই “থ্যালাসেমিয়া বাহক নির্ণয় শিবির এবং সচেতনতা শিবির করাতেন। যাতে এই কাজটি হয়ে যেত। কিন্তু বাধ সাধল করোনা। করোনার জন্য লক ডাউনের জেরে স্কুল বন্ধ থাকায় গত বছর এই শিবির করতে পারেন নি, আর এখন স্কুল খুললেও সব ক্লাশ খোলেনি তাই তিনি স্কুল ছুটির পর মানুষজন কে বোঝাবার জন্য পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে সচেতন করার কাজ করে চলেছেন। সুব্রত বাবুর কথায় -” এর জন্য হয়ত আমার অর্থ ও শ্রম দিতে হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তারজন্য যদি কিছু জন যদি সচেতন হয় ওটাই আমার সার্থকতা। এতে সমাজের একটা বড় ব্যাধি থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছি এটাই বড় পাওনা।” এখন বিয়ের সময় আসছে তাই এই সময়টাকেই বেছে নিয়েছেন মাষ্টারমশাই।
এর আগেও সুব্রত বাবু নিজের টাকায় ” মদ/চোলাই মদের বিরুদ্ধে” একই ভাবে পোষ্টার ছাপিয়ে আদিবাসী গ্রাম গুলোতে স্কুল ছুটির পর লাগাতার সচেতনতা মূলক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
কইমা, ভাদুয়া, মুচিনালা, শাকরারী, ভান্ডারডিহা, নারানপুর, মহাপাল, তপশিয়া প্রভৃতি গ্রামে গেলে দেখা যাবে মাস্টার মশাই এর পোস্টার।
গোপীবল্লভপুর ২ নম্বর ব্লকে এর সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক শ্রী অর্ঘ্য ঘোষ বলেন – সুব্রত বাবুর এই উদ্যোগ অকল্পনীয়। সমাজের মানুষজন যাতে ভালো থাকেন তাঁর এই প্রচেষ্টা কে আমরা কুর্নিশ জানাই।”
বেলিয়াবেড়া থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিক সুদীপ পালোধী বলেন, মাস্টার মশাই এর এই প্রচেষ্টা কে স্যালুট জানাই। উনি কোন সহযোগিতা চাইলেন আমরা দিতে প্রস্তুত।” বেলিয়াবেড়া চক্রের এস.আই. শ্রী তমাল দাস জানান – ” সুব্রত বাবু স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি যেভাবে সমাজের কথা ভাবেন, খুব কম জনই তা ভাবেন বা করেন। উনার কাজই উনাকে আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা করেছে। উনার এই ধরনের কাজ কে সন্মান জানাতেই হয়।” সুব্রত বাবু এক ছাত্র সুখেন্দু খিলাড়ি র কথায় – সুব্রত স্যার একজন আদর্শ শিক্ষক, আমরা উনার ছাত্র হিসেবে গর্ব অনুভব করি”।