দারুচিনি ( Cinnamon )ডাঃ বিশ্বজিৎ ঘোষ
(আয়ুর্বেদ মেডিক্যাল অফিসার, উঃ চন্ডিপুর সদর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, মানিকচক, মালদা) “ সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর, তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন ” কবি জীবনানন্দ দাসের “বনলতা সেন” কবিতায় এভাবেই ফুটে উঠেছে দারুচিনির রূপ।
এই রূপের পাশাপাশি গুনের ক্ষেত্রেও আয়ুর্বেদ দ্রব্যগুন জুড়ে দারুচিনির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীজুড়ে দারুচিনি তার সুঘ্রান ও স্বাদের জন্য মসলা হিসেবে যেমন বহুল পরিচিত আবার অন্যদিকে বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে দারুচিনির সুখ্যাতি রয়েছে।
আয়ুর্বেদ দৃষ্টিকোনে দারুচিনি কটু রস প্রধান, লঘুপাক, কফ ও কাস বিনাশক, কণ্ঠ শুদ্ধিকর, আমদোষ নাশক ভেষজ। রাজনিঘন্টু মতে দারুচিনি ১৯ টি মতো পর্যায়নামে দেশ বিদেশে পরিচিত। যেমন: সংস্কৃত – ত্বক, বাংলা – দারুচিনি, কর্নাট – তজ, তেলেগু – গামু, বর্মা – লুলেঙ্গ এছাড়াও বরাঙ্গ, মুখশোধন, বনপ্রিয়, লাটপর্ণ, সুরস,ইত্যাদিও দারুচিনির নামপর্যায়।
পরিচিতি:
দারুচিনির আদিম জন্মস্থান সিংহলদ্বীপ। মাঝারি গাছ,পাতাগুলি তেজপাতার মত। ছাল ধূসরবর্ণ, খসখসে, পাতাগুলোর বিন্যাস শাখার বিপরীধর্মী। কচিপাতা গোলাপী রং বিশিষ্ট হয় পরে সেটা সবুজ হয়ে যায়।
বসন্তকালে দারুচিনির ফুল ও ফল হয়ে থাকে। প্রাচীন বনৌষধি গ্রন্থ মতে সিংহলের নিগম্বু নামক স্থানের দারুচিনি অতিশয় উৎকৃষ্ট। পুষ্টিগুনে দারুচিনি: ( প্রতি ১০০ গ্রামে) কার্বোহাইড্রেট: ৮০.৬ গ্রাম, প্রোটিন: ৪ গ্রাম, ফ্যাট: ১.২ গ্রাম, ক্যালসিয়াম:১০০২ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম: ৬০ মিলিগ্রাম, আয়রন: ৮.৩ মিলিগ্রাম, ফসফরাস: ৬৪ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম: ৪৩১ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম:১০ মিলিগ্রাম, জিঙ্ক: ১.৮ মিলিগ্রাম। এছাড়াও দারুচিনিতে ভিটামিন এ, থিয়ামিন, ভিটামিন বি ৬, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে ইত্যাদির পাশাপাশি সিনামালডিহাইড, সিনামেট, সিনামিক অ্যাসিড, এসেনসিয়াল অয়েল নামে বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগগুলি বর্তমান।
রোগ নিরাময়ে দারুচিনি:
সুশ্রুত সংহিতার এলাদি গনে দারুচিনির ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে, যা মূলত বর্ণ প্রসাদক, বিষ নাশক ও বিবিধ ত্বকজ বিকারে হিতকর হিসেবে
বর্ণিত হয়েছে। ভৈষজ্যশক্তিগুনে দারুচিনি মূলত যে সমস্ত রোগে কার্যকরী তা হলো,
১.স্বরভঙ্গে: ঋতু পরিবর্তন জনিত কারনে বা হটাৎ ঠান্ডা লেগে কণ্ঠস্বরের বিকৃতি হলে সেক্ষেত্রে ১ গ্রাম দারুচিনি চূর্ণ আধ কাপ গরম জলে রাত্রিতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন ছেঁকে সেই জলটা দিন কয়েক খেতে হবে।
রোগী ধূমপায়ী হলে কিন্তু ধূমপান অভ্যাস থেকে বিরত থাকাই ভাল। ২.মাথা ব্যাথায়: “নাসা হি শিরো দ্বারম” অর্থাৎ আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী নাসা পথকে শিরের (মাথার) দ্বার বলা হয়েছে এবং মূলত ঊর্ধ্বজত্রুগত রোগে(E.N.T) নস্যকর্ম চিকিৎসা এক অদ্বিতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি।
যেখানে ঋতু সন্ধিকালিন সময়ে শ্লেষ্মা বিকৃত হয়েছে বা জ্বরের সাথে মাথা যন্ত্রণার উপসর্গ বর্তমান সেক্ষেত্রে দারুচিনির মিহি চূর্ণ সকাল সন্ধে নস্যির মতো নিলে নাসাপথের শ্লেষ্মা পরিষ্কার হয়ে যন্ত্রণার উপশম ঘটে। এটি সংহিতায় প্রধমণ নস্য কর্ম নামে পরিচিত।
৩.সর্দি – কাশিতে: নাক দিয়ে জল পড়ছে, মাঝেমধ্যে হাঁচি হচ্ছে সাথে খুসখুসে কাশি এক্ষেত্রে এক এক ভাগ দারুচিনির সাথে চার ভাগ মধু মিশিয়ে অবলেহ বানিয়ে দিনে দুই থেকে তিনবার আচারের মতো চেটে খেলে উক্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তবে সাথে ঠান্ডা খাদ্যদ্রব্য সেবন ও শীত উপাচার থেকে বিরত থাকতে হবে।৪.এলার্জির সমস্যায়: শীতকালে অনেকেরই এলার্জির সমস্যা দেখা দেয় তবে আমদোষ জনিত এলার্জির ক্ষেত্রে যেখানে গায়ে চাকা চাকা ভাব ফুটে উঠছে আবার কিছুক্ষন পর মিলিয়ে যাচ্ছে ও চুলকানো ভাব আয়ুর্বেদ দৃষ্টিকোনে এখানে রসবহ স্রোতের দুষ্টি বর্তমান।
এক্ষেত্রে দারুচিনি চূর্ণ এক চামচ উষ্ণ গরম জলের সাথে দিনে দুবার সেব্য। এখানে এই সমস্যার সাথে অনেকেরই কোষ্ঠকাঠন্যের সমস্যা থাকে সেক্ষেত্রে সেটির পর্যাপ্ত চিকিৎসা করা দরকার।
৫.ব্যাথা ও ফোলায়: শোথযুক্ত ব্যথায় ব্যাবহারিক প্রয়োগে দারুচিনি প্রলেপ যথেষ্ট কার্যকরী।
আশানুরূপ ফল পেতে দারুচিনির সাথে (১:২) অনুপাতে নালুকা চূর্ণ মিশিয়ে গরম জলে গুলে পেস্টের মতো করে ঘন্টাখানেক রেখে গরম জলে ধুয়ে ফেলুন। ৬.গ্রহণী রোগের প্রাথমিক চিকিৎসায়: সময়মতো খিদে পাচ্ছে না আবার খেলে হজমের সমস্যা এরূপ দুর্বল অগ্নিবলযুক্ত রোগীরা পরবর্তীতে গ্রহনী রোগাক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে দারুচিনি চূর্ণ আধ গ্রাম মাত্রায় আহারান্তে উষ্ণ জলসহ খেলে ঐ অসুবিধাগুলো চলে যায়। ৭.ঋতুকালীন ব্যাথা বেদনায় ও রজরোধে: বিবিধ কারনে অনেকের ঋতুচক্রে ব্যাঘাত ঘটে ও যন্ত্রনা অনুভব করেন সেক্ষেত্রে ৩ -৪ গ্রাম দারুচিনি দুই কাপ জলে সেদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে হাফ চামচ দারুচিনি গুড়ো মিশিয়ে সেবন করুন।
৮.দাঁতের যন্ত্রনা প্রশমনে: দাঁতের যন্ত্রনা প্রশমনে তুলোয় করে দারুচিনি তেল ব্যাথাযুক্ত স্থানে ধরে বা তেলের অভাবে দারুচিনি গুঁড়ো দাঁতের গোড়ায় টিপে লাগিয়ে দিলে যন্ত্রণার আশু উপশম হয়। ৯. গলক্ষতে: কিছু খেলেই গলা জ্বালা, কখনও ব্যাথা ও স্বরের বিকৃতি হলে এটি গলার ক্ষতের প্রথমবস্থার উপসর্গ।
এক্ষেত্রে এক গ্রাম দারুচিনি চূর্ণ এক কাপ গরম জলে রাতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সেটাকে ছেকে সকাল ও বিকল দুবেলা অল্প অল্প করে খেতে হবে এতে কয়েকদিনের মধ্যে উক্ত সমস্যার লাঘব হয়। ১০. ত্বকের ঔজ্জ্বল্য হীনতায়:
পর্যাপ্ত পরিচর্যা সত্বেও যদি ত্বকের লাবণ্য হারিয়ে যেতে থাকে তাহলে আয়ুর্বেদ মতে সেটি রস দুষ্টির এক বিশেষ লক্ষন এক্ষেত্রে এক মুঠো দূর্বা ঘাস, ৫ গ্রাম মতো কাচা হলুদ ও ২ গ্রাম দারুচিনি একসঙ্গে বেঁটে স্নানের ঘন্টাখানেক
পূর্বে মাখার অভ্যাস করুন এতে উক্ত সমস্যা দূরীভূত হবে।
১১. মেছেতা ও বিবিধ ত্বকজ বিকারে: মুখে কালো ছোপ পড়েছে বা ত্বকের উপরে একজিমার মতো কন্ডুযুক্ত (চুলকানি) ভাব পরিলক্ষিত হলে দারুচিনির ক্বাথ অভ্যন্তরীণ সেবনের পাশাপাশি দারুচিনি বাটা চন্দনের মতো পেস্ট করে দুধের সরের সাথে মিশিয়ে প্রলেপ দিলে মুখ নিষ্কলঙ্ক,আভা যুক্ত হয়। আয়ুশ ক্বাথে দারুচিনি: করোনা আবহে আয়ুশ মন্ত্রালয় নির্দেশিত আয়ুশ ক্বাথ বর্তমানে সর্বজনবিদিত। যেখানে তুলসী,শুট, গোলমরিচের পাশাপাশি দারুচিনিও রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণালব্ধ তথ্যাদির উপর ভিত্তি করে প্রমাণিত হয়েছে যে দারুচিনি উপরিউক্ত গুনগুলোর পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ও মুখ ও গলার ইনফেশনজনিত সমস্যায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক গবেষণার দৃষ্টিকোনে দারুচিনি: বিশ্বব্যাপী দারুচিনি নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হচ্ছে যেখানে দারুচিনির ত্বকে একচল্লিশ টির মতো ভিন্ন স্থিতিশীল যৌগ চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিভিন্ন ক্লিনিকাল ট্রায়ালে প্রমাণিত হয়েছে যে দারুচিনি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি, অ্যান্টি ডায়াবেটিক, অ্যান্টি মাইক্রব্রিয়াল, অ্যান্টি ক্যানসার, লিপিড প্রোফাইল হ্রাসকারক গুন সমৃদ্ধ ভেষজ এছাড়াও এটি হৃদরোগ, স্নায়ুরোগে বিশেষভাবে কার্যকরী।