নিজস্ব সংবাদদাতা: জনসাধারণের কমিটিকে সামনে রেখেই জঙ্গলমহলে ২০১১র দামামা বাজিয়ে ছিল তৃনমূল কংগ্রেস। কিষানজীর প্রকাশ্য ঘোষনা তৃনমূলের ‘যুবরাজ’ শুভেন্দু অধিকারীর হাতেই জঙ্গল সঁপে দিয়ে একের পর এক বিধানসভায় জয় আনতে সাহায্য করেছিল মাওবাদীরের বকলমে জনসাধারনের কমিটি। এরপর ভোটে জিতে তৃনমূলের ক্ষমতায় আসা আর জনসাধারণের কমিটির নেতাদের তৃনমূলের নেতায় রূপান্তর। ঘোষিত এবং অঘোষিত মাওবাদীরাও পরে নাম লিখিয়েছে শাসকদলেই। ২০১১ র আগে ও পরে বোঝাপড়া কার্যত পরিষ্কার হয়ে গেছিল। বাকি যে টুকু ছিল সেও পরিষ্কার হয়ে গেল বুধবার। ঢাকঢাক গুড়গুড় ছেড়ে জনসাধারনের কমিটির একদা মুখপাত্র ছত্রধর মাহাতকে প্রকাশ্য দেখা গেল তৃনমূলের সভায়।
বুধবার, ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুর ১ ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের উদ্যোগে একটি কর্মী বৈঠকে উপস্থিত হলেন ছত্রধর মাহাত। এদিন গোপীবল্লভপুরের হাতিবাড়ি রোড়ের স্টেট ব্যাংক এর সামনের একটি বেসরকারী হোটেলে এই বৈঠকে ছত্রধর মাহাতর হাত ধরে সাতমা অঞ্চলের ৩০ টি পরিবার বিজেপি ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের যোগদান করেন।
শুধু মাত্র তাই নয়, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতার মতোই বক্তব্য রাখেন তিনি । বলেন, গত লোকসভা নির্বাচনের সময় তৃণমূল কংগ্রেস কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে সেটা এমন কিছু নয়। মানুষের ওপর ভরসা, আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে হবে কারণ এই মানুষই পরিবর্তন আনবে। পুরোনো ও নব্য তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীদের মধ্যে যে সংঘাত আছে তার প্রসঙ্গ টেনে ছত্রধর মাহাতো বলেন, পুরোনো যারা তারা দলটাকে ধরে রেখেছেন। নব্য যারা তারা দলটাকে সমৃদ্ধ করেছে। এই দুই এর মধ্যে সমন্বয় রেখে এগোতে হবে । আর তা হলেই ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের মতো ফল আবার হবে।
লোকসভা ও ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে জঙ্গলমহলে মাটি হারিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর কেন্দ্রের মতোই ঝাড়গ্রাম লোকসভা আসনটিও হারিয়েছে শাসক দল । এখানে জিতেছে বিজেপি । পঞ্চায়েত নির্বাচনেও এই জেলায় নিজেদের দাপট দেখিয়ে পদ্ম শিবির শুধু মাত্র অনেক গুলো পঞ্চায়েত আসনেই জেতেনি হারিয়েছে জেলা পরিষদের সভাধিপতিকেও। আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচন । এখন থেকেই জঙ্গলমহলকে পাখির চোখ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্যের শাসক দল চাইছে নিজেদের হারানো জমি ফিরে পেতে । লোকসভা নির্বাচনের পরে হারের কারণ বিশ্লষণ করতে গিয়ে শাসক দল দেখেছে এলাকার তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের দুর্নীতি ও গোষ্ঠী বিবাদ ওই হার এবং তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া অন্যতম কারণ ।
যখন , বামফ্রন্ট সরকারের জমানায়, ঝাড়গ্রাম সহ জঙ্গলমহল এলাকায় মাওবাদী ও তাদের মুখ পুলিশী সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির তান্ডব ও হত্যালীলা সেই সময়ে এই এলাকা দখল করতে তৃণমূল কংগ্রেস দায়িত্ব দেয় শুভেন্দু অধিকারীকে। তার ফলে ২০১১ ও ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জঙ্গলমহলে জিতে যায় তৃণমূল কংগ্রেস। তার পরেও শুভেন্দু অধিকারীর হাতেই জঙ্গলমহল এলাকার রাশ থাকলেও লোকসভা নির্বাচনের পরে এই এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চট্টাপাধ্যায়কে। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারছেনা দেখে ফিরিয়ে আনা হয় শুভেন্দুকে।
বর্তমানে পার্থ ও শুভেন্দু যুগ্ম দায়িত্বে। যদিও তাতেও জঙ্গলমহলের মন খুব একটা টলানো যায়নি। সদ্য হয়ে যাওয়া হুল দিবসের সরকারি অনুষ্ঠানেও পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে এড়িয়ে সেদিনই অন্য একটি বেসরকারি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে দেখা যায় শুভেন্দু অধিকারীকে। এমনিতেই দিন দিন শুভেন্দুকে একাধিক সরকারি এমনকি দলীয় অনুষ্ঠান এড়াতে দেখা গেছে। এই পরিস্থিতিতে ছত্রধরকে লালগড় থেকে গোপীবল্লভপুর তুলে নিয়ে সভা করানোর মধ্যে নতুন সমীকরনের ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন রাজনীতিকরা। মনে করা হচ্ছে জঙ্গলমহলের নেতা হিসেবে ছত্রধর মাহাতকেই সামনে আনতে চাইছে।
বিধানসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, ততই শুধু মাত্র পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারীর মতন প্রথম সারির নেতাদের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব বলে মনে করছে ঝাড়গ্রাম এলাকার রাজনৈতিক মহল। লোকসভা নির্বাচনে হারের পর বিধানসভা নির্বাচনে জঙ্গলমহলের সব কটি আসনে জিততে মরিয়া তৃণমূল কংগ্রেস। তাই পায়ের তলা থেকে সরে যাওয়া মাটি ফেরত পেতে এবার তারা মাঠে নামালো ছত্রধর মাহাতোকে। সেই ছত্রধর মাহাতো, যিনি ছিলেন পুলিশী সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি র মুখপাত্র । যার বিরুদ্ধে দেশেদ্রাহিতার মামলা দেওয়া হয় । ২০০৯ সালে দুর্গাপূজার ঠিক আগে তাকে গ্রেফতার করা হয় । এরপর একের পর এক মামলায় অব্যহতি পান তিনি। শেষ অবধি একটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হলেও সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই, এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। যা নিয়ে অনেককে মনে করেন বর্তমান সরকার ইচ্ছা করেই মামলা চালাতে চাননি।
ছত্রধর মাহাত জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেই তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় । যেদিন তিনি ছাড়া পেয়ে লালগড়ের আমলিয়ার বাড়িতে আসেন সেদিন তার সঙ্গে ছিলেন এক সময়ের তার ছায়া সঙ্গী তথা বর্তমানে লালগড় এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি শ্যামল মাহাতো । এবং তার দিন কয়েক পরেই ও আরও বেশ কয়েকবার একাধিকবার তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি । তখনই মানুষের ধারণা ছিল ছত্রধর মাহাত তৃণমূল কংগ্রেস দলের হয় কাজ করবেন। কিন্তু শাসক দলের সঙ্গে প্রকাশ্যে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন ছত্রধর ।
এদিকে ছত্রধর মাহাতোকে তৃণমূল কংগ্রেস মাঠে নামালেও তাকে কোনও রকম আমল দিতেই চাইছে না বিজেপি । ” ছত্রধর মাহাতো নতুন করে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিল কবে? ও তো প্রথম থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসে আছে। এই এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেসের পায়ের তলায় মাটি সরে গিয়েছে । তাই রাজনৈতিক স্বার্থে তাকে জেল থেকে বের করা হয়েছে । তাকে মাঠে নামানো হয়েছে । আর এর প্রস্তুতি তো আগেই শুরু হয়ে যায় । ছত্রধর মাহাতো যাতে জেল থেকে বের হয়ে তাদের হয়ে কাজ করে তার জন্য আগেই তার দুই ছেলেকে চাকরি দেওয়া হয়েছে । সম্প্রতি তার স্ত্রী কে সরকারি পদ দেওয়া হয়েছে,” বলে মন্তব্য করেছেন ঝাড়গ্রাম জেলার বিজেপি সভাপতি সুখময় শতপথী । তার দাবি এদিন বিজেপি থেকে কেউ তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন নি। সেখানে যে সব তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী উপস্থিত ছিলেন তাদের হাতে নতুন করে তাদের দলের পতাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে ।
উল্লেখ্য যে এই বছর মে মাসে ছত্রধর মাহাতোর স্ত্রী নিয়তি মাহাতোকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সমাজকল্যাণ পর্ষদের সরকার মনোনীত সদস্য করা হয়েছে । ঝাড়গ্রাম এলাকার কংগ্রেস ও সিপিএম নেতৃত্বও বলছেন যে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়েই আগে কাজ করত ছত্রধর মাহাতো। এখন সে যাতে আরও বেশি করে তাদের দলের হয়ে কাজ করে তার জন্য তার স্ত্রী ও পুত্রদের সরকারি পদ বা চাকরিতে বহাল করা হয়েছে ।
অবশ্য একটা সমস্যার দিকও রয়েছে। ছত্রধর মাহাতো যখন শাসক দলের হয়ে প্রকাশ্যে মাঠে নামছেন তখন তাকে রীতিমতো হুমকি দেওয়া হয়েছে আদিবাসী সংগঠনের পক্ষ থেকে । বেলপাহাড়ির বাঁশপাহাড়ি এলাকার চাকাডোবাতে আদিবাসী সংগঠনের একটি সভায় তাদের নেতা পালহান সরেন মন্তব্য করেছেন যে এলাকায় যে অনেক আদিবাসী মানুষ খুন হয়েছে তার জন্য দায়ী মাওবাদী নেতা কিশানজি ও জনসাধারণের কমিটির নেতা ছত্রধর মাহাতো। এখন যদি সেই ছত্রধর মাহাতো পিছন থেকে ছুরি মারতে চায় তাহলে বুঝে নেওয়া হবে । ফলে জঙ্গলে নতুন করে আলোড়নেরও ইঙ্গিত রয়েছে।
বুধবারের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন গোপীবল্লভপুর ১ নম্বর ব্লক তৃণমূলের সভাপতি শঙ্কর প্রসাদ হাঁসদা,ঝাড়গ্ৰাম জেলা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি সত্যরঞ্জন বারিক অবিভক্ত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি লোকেশ কর সহ শুভেন্দু দাস, অভিষেক দাস এর মতো স্থানীয় তৃণমূল নেতারা।