✒️ কলমে: আশিস মিশ্র
পর্ব –৬
আমাদের গ্রাম – বাংলায় যে সব চায়ের দোকান আছে, সেগুলিতে সব রকমারি আড্ডা বসে। বিসম বয়সী মানুষরা বেশির ভাগ পরচর্চা বা পরনিন্দা নিয়ে ব্যস্ত। না হলে রাজনৈতিক দলের নানা কথা। এর বাইরে কিছু চায়ের ঠেক আছে হাইওয়ে বা রাজ্য সড়কের পাশে। যেমন তপনের চায়ের ঠেকটি ছিলো আমাদের যুবকদের আড্ডার জায়গা। অন্যদিকে কাকাবাবুর চায়ের ঠেক। সেখানে প্রবেশের সাহস পেতাম না। সেখানে সব মাস্টার – পন্ডিতদের আড্ডা। সেই সব ঠেকে বসা অনেকেই আজ প্রয়াত। আর চায়ের ঠেকটি স্থান বদলে ফেলেছে। সেখানে তেমন আর আড্ডা বসে না। তপনও একটি গলির মধ্যে চলে যাওয়ায় তার কাছে তেমন আর কেউই যাই না। অগত্যা পুতুল বৌদির চায়ের দোকানে বসে দু’চুমুক…। তারপর আমাদের রবিআড্ডার আসর। তাও কেমন ঝিমিয়ে গেছে।
আসলে হলদিয়া বা মহিষাদল বা চৈতন্যপুরে বা দুর্গাচকে যে সব চায়ের ঠেকে আমাদের সাহিত্য আড্ডা বসতো,তাও আর এখন নেই। তবু ভালো বাজকুলে শেখর পালের চায়ের ঠেকে নিয়মিত আড্ডা বসে কবিদের। শেখরদা নিজে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। নাম ‘ সাথী ‘। শেখরদা কবিতাও লেখেন। দোকানে ঝুলিয়ে রাখেন লিটল ম্যাগাজিন। সে যাই হোক মহিষাদলের মানিকের চায়ের ঠেকে বা রথতলায় চায়ের ঠেকে আমরা অনেকেই বসতাম। সে -সব এখন স্মৃতি। এখন তাই হলুদ রবিবারের বোহেমিয়ান আড্ডাগুলি মোবাইলে বন্দী হয়ে গেছে প্রায় সকলের।
অথচ সেই সব ঠেকে বসে আমাদের কতো নতুন কবিতা লেখার প্রেরণা আসতো। নতুন নতুন লিটল ম্যাগাজিন করার পরিকল্পনা হতো। এখন সে সব হয় না। ঘরে বসে বন্ধুরা সব ব্লগজিন নিয়ে ব্যস্ত। কে পড়বে ওই সব? অতো সময় কোথায়?
সেই সব ঠেকের দিনগুলি ও সেই সব মানুষগুলিকে খুব মনে পড়ে এখন। যেমন কবি চিত্তরঞ্জন মাইতি, আমার স্যার চিত্তরঞ্জন দাস, কবি ও প্রাবন্ধিক হারাধন মহাপা,লেখক ও সাংবাদিক বঙ্কিম ব্রহ্মচারী,” হলদিয়া ” পত্রিকার সম্পাদক হরিপর সিংহ প্রমুখ। আমার তখন সবে একটু লেখালেখি শুরু। এতো সিনিয়রদের কাছে বসতে ভয় পেতাম। তবুও হরিদা, চিত্তদা সবাইকে আপন বন্ধু করে নিতেন। কতো মজার সব ঘটনা বলতেন। তাঁদের কাছে জানতাম হলদিয়ার ইতিহাস। চিত্তদা আক্ষেপ করে বলতেন,” সাহিত্য করে জীবনে কিছু পাইনি। কিন্তু বর্ধমান থেকে তোদের এম এ পাশ বৌদিকে পেয়েছি। ”
হরিদার বসবার জায়গাটি ছিলো কখনো চৈতন্যপুর কখনো দুর্গাচকে মেসোর চায়ের ঠেকে। সেখানে আরও অনেকেই বসতেন। বাহাদুরদা, সত্যেন দা,রামপদ দা, শুভেন্দু স্যার,মধুসূদন ঘাটী প্রমুখ। যোগ দিতেন বটতলার বেনুদা। তিনি সব পত্রিকার বিক্রেতা। সেই বট গাছ আছে ঝিমিয়ে। বেনুদা আর নেই।
হরিদা জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতেন নানা গল্প। কখনো জোকস। এতো সত্যি সব ঘটনাকে জোকস করে বলতে কাউকে তখন শুনিনি। যেমন কোনো এক সংবাদ সাপ্তাহিকে একটি খবর ভুল ছাপা হয়েছে। সম্পাদক তার ভুল সংশোধনী ছাপছেন এমন করে।,”গত সংখ্যায় অমুক পাতার অমুক সংবাদটি ভুল করিয়া পাছা হইয়াছে। ত্রুটি মার্জনা করিবেন।” তা শুনে আমরা হেসে গড়িয়ে পড়তাম। হরিদা বলতেন, “এক চায়ের ঠেকে চায়ের কাপে পিঁপড়ে পড়েছে। দোকানদার বললেন, চায়ের কাপে পিঁপড়েই পড়ে দাদা,হাতি পড়ে না।” হরিদা বলতেন,” দেখ ভায়া নতুন কবিতা লিখতে এসেছো,নতুন সম্পাদক হয়েছো,বিজ্ঞাপন দাতারা সরসময় তোমাকে ‘ না’
বলবেন। সে তার বিজ্ঞাপন দেবেন না। এই না-কে হ্যাঁ করানোর কৌশল জানতে হবে। না হলে তোমার পত্রিকা অকালে বিজ্ঞাপন না পেয়ে মরে যাবে। ”
সত্যি সত্যি হরিদার সেই সব কথা কী বাস্তব ছিলো। তার মধ্যে আমরা অনেকেই আজ বিচ্ছিন্ন ভাবে নানা কাজ করে চলেছি। কেউ কবি,কেউ সাংবাদিক। হরিদা আবার বলতেন, ” ওই দেখো, কী সাঙ্ঘাতিক চলে যাচ্ছে। গরুর রচনাও লিখতে জানে না। ”
সত্যি সত্যি এখন যুগ বদলে গেছে কতো। এখন সকলেই সাংবাদিক। হেঁচে- কেশে ফেললেও তা জেলার পাতায় চলে যায়। অথচ একসময় জেলার পাতা বলে কোনো বস্তু ছিলো না। ফলে এখন হাজার গন্ডা বানান ভুল হলেও তা প্রকাশিত হয়ে যায়। তার কোনো সংশোধনী ছাপা হয় না। যদি ভুল করে তা আবার পাছা হয়ে যায়…
( চলবে)