গনগনি – বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন
কল্লোলিত নদী, বিস্তীর্ণ নদী প্রান্তর, স্বর্গীয় আভায় রাঙ্গানো আকাশ—এই শোভা, এই অপরূপ রূপের মাধুরী দেখে দু চোখের তৃষ্ণা যেন মেটে না। বিশ্বস্রষ্টা যেন নিজেকে আড়ালে রেখে মোহময় সৌন্দর্যের মধ্যে মানুষকে ডুবিয়ে রেখেছেন। রহস্যময় এক মায়ার জগৎ সৃষ্টি করে খেলছেন আড়ালে বসে। সূর্যাস্তের সময় নির্জন নদীতীরে দাঁড়ালে এমন আধ্যাত্বিক ভাবনা ভেসে আসে মনে। দিবসের অবসান আর রাত্রির আগমনের এই পৃথিবী যেন মিলন-বিরহের খেলায় মেতে ওঠে। আকাশ আর মাটি যেন মুখোমুখি মৌনমুখর। ছায়াঢাকা গ্রামের নিবিড় প্রেক্ষাপটে সূর্যাস্তের দৃশ্য ঘোমটা-টানা লাজুক বধূর মতো। সামনে বিশাল জলরাশি,ওপরে রক্তিম উদার আকাশ। আকাশের রক্তিম রঙে নদীর জল রঙিন হয়ে ওঠে। এক সময় মনে হয় নদী আর আকাশ যেন মিশে গেছে দিগন্তরেখায়। সূর্য যেন কান পেতে শুনছে পৃথিবীর গোপন বিষাদের সুর। এইভাবেই একসময় সূর্য যেন ঝুপ করে নদীতে ঝাঁপ দেয় আর পৃথিবীতে নেমে আসে অন্ধকার।
শিলাবতীর তীরে দাঁড়িয়ে এভাবেই কল্পনার জগতে পাড়ি দেওয়া যায়। আমরা নিজেরা যতক্ষণ না পুরোপুরি কোথাও বা কোনোভাবে হারিয়ে যাই, ততক্ষণ নিজেদের পুরোপুরি বুঝতে পারি না। আমরা কি করতে সক্ষম সেটাও ততদিন অজানাই থেকে যায়। প্রকৃতির মাঝে কিছুক্ষন হারিয়ে ফেলতে চাইলে যেতে পারেন ঘরের কাছে এই আরশি নগরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে সারা বিশ্ব থেকে লক্ষ লক্ষ পর্যটক যায়। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই জানেন না, পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতায় রয়েছে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের এমনই একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। এখানে অ্যারিজোনার জায়গায় গনগনি, আর কলোরাডোর জায়গায় শিলাবতী নদী।
মূল রাস্তা ছেড়ে কিছুটা গেলেই কাজু গাছের জঙ্গল। জঙ্গল পেরিয়ে নদীর সাথে প্রথম দেখা। এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে রূপসী শিলাবতী, যার ডাকনাম শিলাই। বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকলেও, বর্ষায় দূরন্ত হয়ে ওঠে। জেলেদের ব্যস্ততা চোখে পড়বে। আর শরতে কাশ ফুলে সেজে ওঠে নদীর দুকূল। নদীর ডানতীর বরাবর লাল মাটির গভীর খাদ। যেন কোন শিল্পী তার আপন খেয়ালে বানিয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য । কি অপূর্ব সৃষ্টি! প্রকৃতি আপন খেয়ালে তৈরি করেছে নিজের সাম্রাজ্য, নিজের গুহা, নিজের সিংহাসন। নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে প্রায় ১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ল্যাটেরাইট মাটিতে এরকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়েছে। নদীর পাড় বরাবর প্রায় ৩০-৫০ মিটার উচ্চতার এই ভূমিরূপ। খাড়া ঢালের মধ্যবর্তী অংশে অজস্র ছোট ছোট নালা। গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রে এখানকার মাটি টকটকে লাল হয়ে ওঠে, যা উনুনের আঁচের মত গনগনে। তাই হয়তো নাম গনগনি। তবে স্থানীয়রা ‘গনগনির ডাঙ্গা’ বলে। নদীর দুইপারে সবুজ বনভূমি। নাম না জানা বনফুল আর অজস্র প্রজাপতি। শীতকালে পিকনিকের সময় ছাড়া সারা বছরই জায়গাটা নিরিবিলি থাকে। ভূগোলের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষামূলক ভ্রমণের জন্য আদর্শ পরিবেশ। তাছাড়া গনগনির সূর্যাস্ত দেখার জন্য প্রকৃতিপ্রেমিক ও ফটোগ্রাফারেরা ছুটে যায়।
লোককথা অনুযায়ী, কয়েক হাজার বছর আগে এই গ্রামে জনৈক বকাসুর বা বকরাক্ষসের ভয়ে গ্রামবাসীরা তটস্থ ছিল। যখন খুশি একটা করে মানুষ ধরে খেয়ে ফেলছে। রাক্ষসের উদরপূর্তির ঠেলায় গ্রাম উজাড় হওয়ার যোগাড়। উপায়ান্তর না দেখে গ্রামবাসীরা মিলিতভাবে প্রাণভিক্ষার আর্জি নিয়ে হাজির হয় রাক্ষসের ডেরায়। রাক্ষস জানাল, তাকে যদি রোজ একজন করে মানুষ সরবরাহ করা হয়, তাহলে সে যখন খুশি একে-ওকে মেরে ফেলা থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। গ্রামবাসীরা তাতেই রাজি। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিল, গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে ব্যক্তি পালা করে রাক্ষসের খাদ্য হবে।
সেইসময় মহাভারতের পঞ্চ পাণ্ডব আর মাতা কুন্তী বনবাসকালে আসেন এখানকার এক গৃহস্থের ঘরের অতিথি হয়ে। পরের দিন সকালে সেই গৃহস্থের বাড়িতে কান্নার রোল, তাদের একজনকে রাক্ষসের কাছে যেতে হবে। শেষে মাতা কুন্তীর আদেশে গৃহস্থের বদলে ভীম যান রাক্ষসের কাছে। ভয়ংকর যুদ্ধ হয় ভীম আর বকরাক্ষসের মধ্যে এই গনগনি অঞ্চলে। দুই শক্তিমান যোদ্ধার পায়েরর চাপে মাটি কোথাও বসে গিয়ে, কোথাও উঠে গিয়ে এই ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। যুদ্ধে বকরাক্ষসের মৃত্যু হয়। তার রক্তে মাটি লাল হয়ে যায়। আজও মানুষ নদীঘাতের একটি বিশেষ অংশকে বক রাক্ষসের গুহা বলে থাকে।
শুধু লোককথাই নয়, ঐতিহাসিক গুরুত্বও কম নয় এই জায়গার। চুয়াড়-লায়েক বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক অচল সিংহ তাঁর দলবল নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিলেন গনগনির গভীর শালবনে। রপ্ত করেছিলেন গেরিলা যুদ্ধকৌশল। ইংরেজদের ব্যাতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন। ইংরেজ বাহিনী কামান দেগে জ্বালিয়ে দিয়েছিল গোটা শালবন। তবু দমানো যায়নি অচলকে। চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে যান তিনি। অবশ্য শেষরক্ষা করতে পারেননি। বগড়ির শেষ রাজা ছত্র সিংহ ধরিয়ে দেন অচলদের। এই গনগনির মাঠেই নাকি অচল ও তাঁর সঙ্গীদের ফাঁসি দিয়েছিল ইংরেজ।
যাতায়াত :-
◆ সাঁতরাগাছি থেকে সকালের এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রায় তিন ঘন্টায় গড়বেতা স্টেশন। খড়গপুর/মেদিনীপুর থেকেও লোকাল ট্রেনে গড়বেতা যাওয়া যাবে। স্টেশন থেকে টোটোতে চার কিমি দূরে গনগনি।
◆ কোলকাতা বা মেদিনীপুর স্টেশন থেকে সরাসরি গড়বেতা যাওয়ার অনেক বাস আছে।
◆নিজস্ব গাড়ি বা বাইকে পাঁশকুড়া- ঘাটাল- চন্দ্রকোণা হয়ে অথবা খড়গপুর চৌরঙ্গী- শালবনী- চন্দ্রকোণা হয়ে গড়বেতা যাওয়া যাবে।
আর কি কি দেখবেন :- একটা টোটো ভাড়া করে ঘুরে দেখতে পারেন – প্রাচীণ সর্বমঙ্গলা মন্দির, বার শিবের মন্দির, মঙলাপোতার ভগ্ন রাজবাড়ি (দুর্গা পূজা হয়), মায়তা কৃষ্ণরায় জীউ-র মন্দির (রথযাত্রা হয়), বগড়ী কৃষ্ণরায় জীউ-র মন্দির (নদীর ধারে মনোরম পরিবেশ) – রাধাবল্লভ মন্দির, রাধানাথ সিংহ স্মৃতি মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, শ্যাম ভবনে শ্যামের মন্দির, আমলাগোড়া ও বাগডোবা জঙ্গল।
থাকার জন্য :-
সোনাঝুরি গেস্ট হাউস – 9547514030
পূর্ণিমা গেষ্ট হাউস – 947405931
আপ্যায়ণ গেষ্ট হাউস – 9434139135
স্টার গেস্ট হাউস – 9733654292
বংশী ভবন – 9434104245
শ্যাম ভবন ধর্মশালা – 9832782293
বিশুদার হোমস্টে – 8967665172
খাওয়ার জন্য :-
◆ মনপসন্দ রেস্টুরেন্ট (নতুন হাট) – 7407390505
◆ সুরুচী রেস্টুরেন্ট (কলেজ মাঠের কাছে) – 9609455602
◆ আহার রেস্টুরেন্ট (কলেজ গেটের বিপরীতে) – 9735502930
◆ হাজরা ধাবা (হাইওয়ের পাশে)
◆ রাধানগর চৌরাস্তার মোড়ে ‘বাচ্চুদা’র তেলেভাজার দোকান
মনে রাখবেন :-
◆ গনগনি যাওয়ার আদর্শ সময় – বর্ষাকাল এবং শরৎকাল (পুজোর আগে)
◆ নদীখাতের বিপজ্জনক অংশে যাবেন না বা অন্যমনস্কভাবে সেলফি তুলবেন না।
◆ বেড়াতে গিয়ে কোনরকম আববর্জনা ফেলে আসবেন না।