তিতলী সেনগুপ্ত : ঘড়িতে তখন ভোর ৫টা। বিছানায় অঘোরে ঘুমাচ্ছে বছর ২০-র এক তরুণী। আচমকা একটা শব্দ,তারপরই চিৎকার! পাড়ার লোক বেড়িয়ে আসতেই জানা গেল খুন হয়েছে পাড়ার মেয়ে প্রিয়াঙ্কা পুরকায়েত। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে তার মাথায় গুলি করা হয়েছে। সাত সকালে এমন ঘটনায় হতবাক রিজেন্ট পার্ক থানা এলাকার আনন্দপল্লি-র বাসিন্দারা। গুলির শব্দেই ঘুম ভাঙে বাড়ির বাকি সদস্যদের। সেই সময় বাড়িতে ছিল তরুণীর ভাই ও অসুস্থ পিসি। ওমেনস ক্রিশ্চিয়ান কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী বছর ২০-র প্রিয়াঙ্কা রিজেন্ট পার্কের বাড়িতে দুই পিসি, ভাই এবং মায়ের সঙ্গে থাকতেন। বাবা বছর দেড়েক আগেই মারা গিয়েছেন। বড় পিসি কয়েক বছর যাবত চলনশক্তি হারিয়েছেন। তাই সংসারের হাল মা আর ছোট পিসিকেই ধরতে হয়। মা ও পিসি দুজনেই কর্মসূত্রে বেরিয়ে যান ভোরে। প্রতিদিনের মতো শনিবারও তারা বাইরে থেকে দরজা ভেজিয়ে ভোরবেলাতেই বেরিয়ে যান। সেই ফাঁকে আচমকাই এক যুবক ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে খুব কাছ থেকে প্রিয়াঙ্কার মাথায় গুলি করে পালিয়ে যায়। গুলির শব্দে চমকে উঠে প্রিয়াঙ্কার পিসি ছেলেটিকে দেখে চিনতে পারেন। কিন্তু কে এই যুবক? প্রিয়াঙ্কার সাথে কি এমন সম্পর্ক তার? কেনই বা ঘরে ঢুকে খুন করতে হল তাকে?
জানা গিয়েছে, পেশায় গাড়ির চালক এই যুবক পাশের পাড়ার জয়ন্ত হালদার। প্রিয়াঙ্কার সাথে চার বছরের সম্পর্ক ছিল। সম্প্রতি সম্পর্কে টানাপোড়েনের জেরেই খুন বলে মনে করা হচ্ছে। সম্প্রতি প্রিয়াঙ্কা জানতে পারে জয়ন্ত বিবাহিত। এমনকি তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা!কিন্তু সম্পর্কে থাকাকালীন পুরো বিষয়টিই প্রিয়াঙ্কার কাছ থেকে গোপন করেছিল ওই যুবক। এর মধ্যেই সে প্রিয়াঙ্কাকে বিয়ের প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু পড়াশোনা শেষ না হওয়ায় এখনই বিয়ে করতে রাজি হয়নি প্রিয়াঙ্কা। কিন্তু দিন দিন সেই প্রস্তাব চাপে পরিণত হতে থাকে। সম্প্রতি প্রিয়াঙ্কা জয়ন্তর বিয়ে এবং স্ত্রীর অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর জানতে পারে। এই দুটি কঠিন সত্যি মেনে নিতে পারেনি প্রিয়াঙ্কা। দীর্ঘ ৪ বছরের সম্পর্কে কিভাবে তাকে তার প্রেমিক এতটা ধোঁয়াশার মধ্যে রাখলো তা বুঝতে না পেরে অভিমানে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয় তরুণী। কিন্তু জয়ন্ত কিছুতেই তাকে ছাড়তে রাজি নয়। জয়ন্ত তার স্ত্রী-কে ডিভোর্স দিয়ে ফের প্রিয়াঙ্কাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু প্রিয়াঙ্কা কিছুতেই একটা মেয়ের ঘর ভেঙে সেই সম্পর্কে ফিরতে রাজী হয়নি৷ দুজনের মধ্যে কিছুদিন যাবত এই নিয়ে অশান্তি চরমে পৌঁছেছিল। এমনকি জয়ন্ত তাকে খুনের হুমকিও দিয়েছিল। কিন্তু সেই হুমকিই যে সত্যি হয়ে যাবে তা কখনই ভাবেনি প্রিয়াঙ্কার পরিবার।
জানা গিয়েছে, প্রতিদিন ভোরে বাড়ির পিছনের দিকের দরজা খুলে বাইরে থেকে ভেজিয়ে কাজে চলে যেতেন প্রিয়াঙ্কার মা ও পিসি রত্না। শনিবার তারা চলে যাওয়ার পর সেই দরজা দিয়েই ভোর পাঁচটা নাগাদ প্রিয়ঙ্কার ঘরে ঢোকে জয়ন্ত। এরপর পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে তরুণীর মাথায় গুলি করে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় প্রিয়াঙ্কার। পাশেই পিসি শুয়ে ছিলেন। কিন্তু অক্ষম হওয়ায় বাধা দিতে না পেরে চোখের সামনেই ভাইঝিকে ছটফট করে মরতে দেখেন তিনি। গুলি করেই সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে যান যুবক। এদিকে সাত সকালে এমন শব্দ শুনে স্থানীয় বাসিন্দারা বাইরে বেরিয়ে আসতেই প্রিয়াঙ্কার পিসির কান্নার শব্দ শুনতে পান। এরপর তড়িঘড়ি থানায় খবর দেওয়া হলে ঘটনাস্থলে বিশাল পুলিশবাহিনী পৌঁছে তরুণীর দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত পাঠানো হয়। ইতিমধ্যেই ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ৷
তবে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, প্রিয়াঙ্কার বাড়ি সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিল জয়ন্ত। সে জানতো প্রিয়াঙ্কার যে বাড়ির পিছনের দিকের দরজা ভোরবেলা খোলা থাকে। এমনকি প্রিয়াঙ্কার পিসি যে অক্ষম তাও সে ভালই জানতো। সেই সুযোগেই শনিবার ঘরে ঢুকে গুলি চালানোর পরিকল্পনা করে সে। ঘটনার পর থেকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না প্রিয়াঙ্কার প্রাক্তন প্রেমিককে। তাঁর খোঁজে ইতিমধ্যেই তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ। জয়ন্তের পরিবারের সদস্যদের জেরা করা হচ্ছে। অন্যদিকে পাড়ার মেয়ের এমন পরিণতিতে শোকের ছায়া কলকাতার রিজেন্ট পার্কের আনন্দপল্লী এলাকায়।