অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো আস্ত একটা সমুদ্র সৈকত কিনব। অবশেষে একদিন সে ইচ্ছে পূরণ হোল। না, এই বিকিকিনি টাকা পয়সায় হয়নি, হয়েছে হৃদয় দিয়ে। হৃদয় বাঁধা পড়ে গেছে এখানে। মনে হয়, কাজ–কর্ম, ঘর–সংসার, স্বজন–সুজনদের ভুলে যাই। মনে হয়, এখানেই কাটিয়ে দিই বাকি জীবনটা। একটা দিন যেন প্রকৃতির মায়াজালে নিজেকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলাম।
আশ্চর্য এক নীরবতা সারা সৈকত জুড়ে। ওড়িশার এই সমুদ্র সৈকত এখনও অধিকাংশেরই অজানা। জনপ্লাবণ এখনও আছড়ে পড়েনি দীঘা–পুরীর মতো। লাল কাঁকড়াদের ত্রস্ত লুকোচুরি, গাঙচিলেদের জলকেলী, জেলে নৌকার আনাগোনা, মাছের কেনাবেচা, দিগন্ত বিস্তৃত ঝাউবাগানের সবুজ পাঁচিল, বাতাসের অবিরাম সোঁ সোঁ শব্দ, সূর্যোদয় আর সুর্যাস্তে সাত রঙের মোহিনী খেলা, সমুদ্রের ক্লাসিক্যাল ছন্দ। এসব নিয়েই আমার প্রিয় দাগারা সৈকত।
অজানাকে জানা আর অচেনাকে চেনার টানেই তো বাইরে বেরুনো। জ্যৈষ্ঠ মাসের কাঠফাটা গরমকে থোড়াই কেয়ার। বাইকে ফুল ট্যাঙ্ক তেল ভরে বেরিয়ে পড়েছিলাম। সঙ্গে বন্ধু সৈকত। বাইক ছুটছে বেলদা হাইওয়ে ধরে। মাঝে বার দুই–তিন ব্রেক। গুগল ম্যাপ আর লোকাল মানুষজনের কাছে পথের হদিশ জেনে নেওয়া। দাগারা সৈকতে পৌঁছলাম যখন, ঘন্টা আর মিনিটের কাঁটার গলাগলি জড়াজড়ি। কাঁটায় কাঁটায় বারোটা।
আগে–ঘুরে–যাওয়া বন্ধু সুব্রতদা জানিয়েছিলেন, এখানে স্থানীয় বাসিন্দা গণেশ বেহেরা বাড়িতে একটি মুদি দোকান ও খাবারের হোটেল করেছেন। আমরা দুজন যাচ্ছি বলে ফোন করে জানিয়ে রেখেছিলাম। সেইমতো ডিমের ঝোল ভাত রেডি। পেটের মধ্যে তখন ক্ষুধার কালবৈশাখী। ডিমের ঝোল দিয়ে মেখে গরম গরম ভাত গোগ্রাসে পেটে চালান করে, আসন্ন ঝড় রোধ করা গেল।
আমরা গল্প করতে করতে গনেশবাবুকে দাদু পাতিয়ে ফেললাম। বয়ষ্ক ভদ্রলোকটি যেমন অমায়িক, তেমনই অতিথি পরায়ণ। তখন সময়টা ছিল ২০১৮ সাল। দাগারায় কোন থাকার হোটেল ছিল না। দাদুর ঘর লাগোয়া তিনটে দোকানঘর আছে। একটিতে ওনার নিজের মুদি দোকান, অন্য দুটি খালি। একটাই তো রাত! ভাবলাম, রাতটা তারই একটিতে কাটিয়ে দেব। তিনিও এককথায় রাজী। বললেন– কষ্ট হবে এঘরে। থাকতে পারলে থাকো। “Not to be a tourist, to be a traveler”– বেড়াতে গেলে কথাটি আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি।
অ্যাজবেস্টসে ছাওয়া ঘর, অ্যায়শা বড় দরজা, কিন্তু কোন জানালা নেই। তবে কপাল ভালো, মশাও নেই। থাকার মধ্যে একটা ছোট তক্তোপোষ, একটা চাদর আর দুটো বালিশ। একেবারে রাজকীয় বন্দোবস্ত। আর হ্যাঁ, একটা সিলিং ফ্যানও আছে। ঘোরেও বনবন করে। কিন্ত হাওয়া লাগে না গায়ে। ঘরের সামনে একটা জলের কলও আছে। হোলই বা তার ঘোলাজল, কিন্তু এত ঠান্ডা যে এই গরমে স্নান করলে প্রাণটা জুড়িয়ে যাবে। এতসব ব্যবস্থা সহ একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়া গেছে, এটাই বড় কথা। এটাই আমাদের রাজমহল।
এরপর সোজা সমুদ্রে। সমুদ্র এখানে পুরীর মতো দামাল ছেলে নয়, একদম সুবোধ বালক। কতক্ষণ যে সমুদ্রের সাথে সময় কাটালাম, ঘড়িতে মাপা হয়নি। চলল দেদার হুল্লোড়, দেদার সেলফি। দুএকজন স্থানীয় লোক আর জেলেরা ছাড়া, আর কাউকে চোখে পড়ল না। যেন এ আমাদের প্রাইভেট বীচ। এখন “আই এম দ্য মনার্ক অফ অল আই সার্ভে”।স্নান পর্ব সেরে, রাজমহলে ফিরে একটু বিশ্রাম। সূর্যাস্তের আগে আবার চলে গেলাম সমুদ্র সৈকতে। কিছু জেলেনৌকা সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে। সৈকতের সোনাবালি সোঁ সোঁ উড়ে যাচ্ছে দমকা হাওয়ায়। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। এক এক জায়গায় বালি জমে তৈরি হচ্ছে বালির পাহাড়। সারা বীচ জুড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়া আর তাদের অবিরাম লুকোচুরি খেলা।
আমাদের রাতের আস্তানা সেই দোকানঘরে থুড়ি রাজমহলে ফিরে এলাম। বাইরে বারান্দায় সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। এই পরিবেশে একমাত্র মাদুরই এখন মানায়। পেতে বসে পড়লাম। দাদু লঙ্কা, পেঁয়াজ, চানাচুর দিয়ে মাখা মুড়ি ধরে দিলেন। খেতে খেতে গল্পগুজব করছি। দিলদরিয়া মেজাজ। ভাবলাম, একটু বনফায়ার করলে কেমন হয়? দাদু শুকনো কিছু কাঠের ব্যবস্থা করে দিলেন। শুরু হল আমাদের বনফায়ার, সাথে বাজল মোবাইলের গান। রাতের খাবারে দেশী চিকেন কারি ও রুটির আয়োজন। দাদুর হাতে যত্ন করে রান্না করা। বনফায়ারের সাথে ডিনারের এই মেনু— আলাদা একটা মাত্রা এনে দিল। এ যেন মেড ফর ইচ আদার। সারাদিন ভালোই ধকল গেছে। এখন আর দেরি নয়। বিছানায় পড়তে না পড়তেই, কয়েক মিনিটেই চোখে ঘুম নেমে এল।
সকালে উঠে দেখি আকাশের মুখ গোমড়া। সূর্যোদয় দেখা হল না ঠিকমতো। দেখলাম গাংচিলের দল জলকেলী করে বেড়াচ্ছে। আর দেখলাম জেলেদের অদ্ভুত কর্মকান্ড। একটা করে নৌকো তীরে আসছে, তাকে পেছন দিক থেকে ট্রাক্টর দিয়ে ঠেলে জল থেকে ডাঙায় তোলা হচ্ছে। জাল থেকে মাছ ছাড়িয়ে, বাছাই করে, শুরু হল নিলাম। যে ক্রেতা কেজি প্রতি বেশি দাম দেবে, সে–ই কিনতে পারবে। আমিও জীবনে প্রথমবার এই নিলামে অংশ নিলাম। মাত্র ১০০ টাকা দিয়ে বেশ কিছু মাছ কিনে ফেললাম— চিংড়ী, সাঁকি, তারই, কোড়মা, পাটিয়া, ট্যাংরা এইসব। গণেশদাদুর জিম্মা করে দিলাম মাছগুলো। তিনিও রান্না করে দিলেন। আহা, টাটকা মাছের কী দারুন স্বাদ। হাতে সময় কম। ভোজন পর্ব সমাপ্ত করে দাগারাকে বিদায় জানানোর পালা। গনেশদাদুর পাওনা মেটাবার সময় কথা দিয়ে আসতে হোল— আবার আসব এখানে। কোনো এক পূর্ণিমা রাতে।
কীভাবে যাবেন : হাওড়া বা খড়গপুর থেকে সকালের ধৌলি এক্সপ্রেসে অথবা ওড়িশা/ দক্ষিণ ভারত গামী যেকোন ট্রেনে জলেশ্বর (দাগারা থেকে ৬০ কিমি) বা বাসতা (দাগারা থেকে ৬৫ কিমি) স্টেশনে নেমে, দরদাম করে অটো ভাড়া করে প্রায় দেড়/দু ঘন্টায় দাগারা বীচ। ভাড়া ৫০০–৭০০ টাকা।
◆ নিজস্ব বাইক বা গাড়িতে খড়গপুর বাইপাস থেকে নারায়ণগড়, বেলদা, দাঁতন, জলেশ্বর, বালিয়াপাল, কালিপডা বাজার হয়ে দাগারা বিচ। বাবুঘাট থেকে নাইট সার্ভিস বাসেও জলেশ্বর/বালিয়াপাল যাওয়া যায়। ◆ দীঘা থেকেও গাড়ি ভাড়া করে, চন্দনেশ্বর – কমরদা – বালিয়াপাল – কালিপডা বাজার হয়ে দাগারা বীচ ঘুরে আসতে পারেন (৫৫ কিমি)।
কোথায় থাকবেন : আমি ছিলাম গনেশবাবুর দোকানঘরে (‘মা‘ রেস্টুরেন্ট)। এখন বেশ কয়েকটি থাকার হোটেল/হোম স্টে হয়েছে। ◆ প্যারাডাইস কমপ্লেক্স (7008004307) ◆ লক্ষ্মী হোটেল (9937375069) ◆ দেবী হোটেল (9348680945) ◆ দাগারা গেস্ট হাউস (7719190069)
কোথায় খাবেন : যে হোটেলে থাকবেন, সেখানেই খাবার ব্যবস্থা করে দেবে। তাছাড়া, গণেশবাবুর ‘মা‘ রেস্টুরেন্ট এবং পাশে ‘মা মনসা‘ নামে একটা খাবারের হোটেল আছে। এগুলিতে খাবার অর্ডার আগে থেকে দিতে হয়। মাছ–মাংস কিনে দিলেও রান্না করে দেয়। বীচের পাশে কয়েকটি চা–পানের দোকান আছে। সাইট সিয়িং : এখান থেকে চাঁদমনি বীচ, যমুনাশোল বীচ, জাম্ভীরাই বীচ, চৌলটি বীচ, কাশাফল বীচ, চৌমুখ মোহনা, বালিয়াপাল জগন্নাথ মন্দির ইত্যাদি দেখতে পারেন। দীঘা থেকে দাগারা বীচ যাওয়ার পথে ভূষন্ডেশ্বর শিব মন্দির ও কীর্তণীয়া মাছের বাজার দেখে নেবেন।
কিছু কথা : ◆ যত্রতত্র আবর্জনা ফেলবেন না। ◆ সমুদ্রের গভীরে নামবেন না। এখানে, শীতকালে পিকনিকের মরসুম ছাড়া, কোনো পুলিশি নজরদারি বা নুলিয়া থাকে না। ফলে, আপনার অসতর্কতায় বড় বিপদ হতে পারে। ◆ বীচের ওপর গাড়ি চালাবেন না। বীচের ওপর মদ্যপান করবেন না বা মদ্যপান করে সমুদ্রে নামবেন না।◆ আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, যাওয়ার পথে, নিকটবর্তী কালিপডা বাজার (৬ কিমি) থেকে সংগ্রহ করে নেবেন। কারণ, দাগারাতে শুধু চা, বিস্কুট, মুড়ি, কোল্ড ড্রিঙ্কস্, মিনারেল ওয়াটার এইসবই পাবেন