নিজস্ব সংবাদদাতা: দুর্ঘটনায় রাস্তায় পড়ে আছেন মৃত মা আর মায়ের সেই রক্তাক্ত দেহের ওপরেই মাথা খুঁড়ছেন ছেলে। কারন তার জন্যই জীবন গিয়েছে হতভাগিনী মায়ের। পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ী-বেলদা রাজ্যসড়কে শুক্রবার রাত ১০টার এই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে গেছেন এলাকাবাসীরা। ওই তরুনের বাবাকে গ্রামের তরফে জরিমানা করা হয়েছিল ৩ হাজার টাকা। তিনি তা দিতে পারেননি বলে তাঁকে বাড়ি থেকে চ্যাংদোলা করে তুলে এনেছে গ্রামবাসীরা। চলছে বিচার, সেই খবরই রাতে থানায় পৌঁছাতে যাচ্ছিলেন জীবনে কখনও বাড়ির বাইরে না বেরুনো গৃহবধূ আর রাস্তাতেই তাঁকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায় বালি ভর্তি একটি ডাম্পার। ঘটনাস্থলেই প্রান হারান তিনি। অভিযোগ গ্রাম্য বিচার বা সালিশিতে মোড়লি করেছিললেন গ্রামের বিজেপি নেতারাই। যদিও বিজেপির দাবি গ্রাম্য বিষয়কে রাজনীতির রং লাগাচ্ছে তৃণমূল।
ঘটনা পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ী থানার কুলাসিনি গ্রাম। সেই গ্রামেরই এক তরুন মানস দে। মানস ভুবনেশ্বরের একটি কলেজে পড়াশুনা করে। কয়েকদিন আগেই সে বাড়ি ফিরেছিল। মানসের পরিবারের দাবি সরকারি নিয়ম মেনেই হোম কোয়ারেন্টাইনে ছিল সে। একদিন থাকার পর মানসের ।বাড়িতে চড়াও হয় স্থানীয় বিজেপি নেতা ও নির্বাচিত পঞ্চায়েতের স্বামী দীপঙ্কর মাইতি, সঞ্জীব দে, দিলীপ ভূঞারা। যেখানে অন্যরা কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে আছে সেখানে মানস ‘কি এমন জমিদারের ব্যাটা’ যে সে ঘরে থাকবে? এই অভিযোগ তুলে ডেকে আনা হয় তার বাবা গৌরীশঙ্কর দে কে। সালিসি সভা বসিয়ে ঠিক করা হয় ৩হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে এবং মানসকে প্রাইমারি স্কুলের কোয়ারেন্টাইন সেন্টারেই পাঠাতে হবে। গৌরীশঙ্কর সেই শর্ত মেনেও নেন।
শুক্রবার রাত ৯টা হয়ে যাওয়া স্বত্তেও কেন ছেলেকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়নি এই অভিযোগ তুলে ফের বাড়ি থেকে তুলে আনা হয় গৌরীশঙ্কর। রীতিমত চ্যাংদোলা করে তাকে তুলে আনা হয়। নিয়ে আসা হয় গ্রামের নির্মীয়মান শিবমন্দিরে। ফের তার জরিমানার পরিমান বাড়ানো হয়। চলতে থাকে হুমকি, তর্জন গর্জন।
কুলাসিনি গ্রামের এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, প্রায় দু’আড়াইশ লোক মিলে ঘিরে ধরে গৌরীশঙ্করকে। চলতে থাকে শাসানি। ঘটনায় ভয় পেয়ে যান গৌরীশঙ্করের স্ত্রী মনিমালা। গৌরীশঙ্কর একটি দোকানের কর্মচারী যার মালিক শম্ভু দাস। শম্ভুর বাইকে চেপে রাতেই থানাকে খবর দিতে কেশিয়াড়ী থানার দিকে রওনা হন তিনি। কেশিয়াড়ী-বেলদা রাজ্য সড়কে পাঁচিয়াড় থেকে যখন কেশিয়াড়ীর দিকে যাচ্ছিলেন তখন একটি বালি বোঝাই ডাম্পার সজোরে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই প্রান হারান মনিমালা।
খবর পেয়েই ছুটে আসে মনিমালার ছেলে মানস, গৌরীশঙ্কর সহ গ্রামের কিছু লোক। জুটে যায় আশেপাশের লোকেরা। রাস্তা পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তারই মধ্যে কিছু লোক আবার বেপরোয়া গাড়ির দৌরাত্ম ও পুলিশের নিস্পৃহতা নিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মায়ের রক্তাক্ত মৃতদেহের ওপরেই পড়ে আছড়ে মাথা খুঁড়তে দেখা যায় মানসকে। সে বারবার হাহাকার করে বলতে থাকে এই মৃত্যুর জন্য সেই দায়ী। খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন বেলদার এসডিপিও, কেশিয়াড়ীর আইসি। মৃতদেহ উদ্ধার করে জনতাকে শান্ত করে রাস্তা যানজট মুক্ত করে পুলিশ।
তৃনমূলের দাবি এই পুরো ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কাজ করছে। গৌরীশঙ্কর একসময়ে এলাকার তৃণমূল বুথ সভাপতি ছিল আর সে কারনেই পরিকল্পিত ভাবেই হেনস্থা করা হচ্ছিল গৌরীর পরিবারকে। যদিও বিজেপির কেশিয়াড়ীর উত্তর মন্ডলের সভাপতি যুগজিৎ পালুই দাবি করেছেন, একটা গ্রাম্য বিষয়কে নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে বিজেপির কোনও যোগসূত্র নেই। কিন্তু মহিলা এত রাতে থানায় যাচ্ছিলেন কেন? ফোন করলেই তো হত। জানা গেছে মানস অনেকবারই থানার ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছিল কিন্তু সাড়া মেলেনি। খবর জানত এলাকার ভিলেজ পুলিশও। তারাও কিছু বলেনি। বাধ্য হয়েই মনিমালা থানায় ছুটে যাচ্ছিলেন।