নিজস্ব সংবাদদাতা: ঝাড়গ্রাম জেলার হাতিবাড়ি কিংবা ওড়ো অথবা ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের ওপর সার সার লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে ভিন রাজ্যের বাস। মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু,গুজরাট মায় পাঞ্জাবের। হাজারে হাজারে, কাতারে কাতারে, পিল পিল করে মানুষ নামছেন। মিডিয়ার দৌলতে এখন এঁদের সবাই চিনে গেছেন পরিযায়ী শ্রমিক নামে। বাংলার সীমান্তে উগরে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে ভিন প্রদেশের বাস গুলি। লম্বা লাইন দিয়ে ফের আরেক দফায় শারীরিক পরীক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে।
পরীক্ষা মানে কপালের সামনে থার্মাল গান ঠেকিয়ে জেনে নেওয়া শরীরে অত্যধিক তাপমাত্রা আছে কিনা। হাজার হাজার লোক আর স্বাস্থ্যকর্মী হাতে গোনা কয়েকজন। এই হাজার হাজার লোকের ঠিকানা বেল পাহাড়ী, বিনপুর, জামবনী, রানিবাঁধ, রায়পুর, এককথায় জঙ্গলমহল। এখন রাজনীতির সময় নয়, করোনা সংক্রান্তি, না’হলে অনিবার্য রূপে প্রশ্নটা উঠেই যেত যে তাহলে পরিবর্তনটা হল কোথায়? পিঁপড়ের ডিম খাওয়ার সেই যে কাসুন্দি ঘেঁটে, রক্তের হোলি আর শতশত খুনের বিনিময়ে আকাঙ্খিত সোনার জঙ্গলমহল গড়ার স্বপ্ন! তার হলটা কি? কেন এখনও হাজারে হাজারে মানুষ পরিযায়ীর পোশাক পরে ভিটে মাটি ছেড়ে ভিন রাজ্যে ঘাম ফেলতে ছোটে? কিন্তু না। এখন রাজনীতির সময় নয়।
চিচড়া চেক পোস্ট এখন নেই বটে তবে তার রেশটুকু রয়ে গেছে। তারই পাশে তার্পোলিন আর খড় চাপিয়ে একটা কিম্ভুত আকারের ঝুপড়ির মধ্যে বসে রয়েছেন গুটি কয়েক স্বাস্থ্যকর্মী। রোদে গরমে ভাপতে ভাপতেই চলছে কাজ। বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টা থেকে রাত প্রায় আটটা বেজে গেছে কাজ শেষ করতে। রোদে দাঁড়িয়ে শরীর পোড়াতে পোড়াতে দম বেরিয়ে যাচ্ছে পুলিশ কর্মীদের। জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠের দায়িত্ব এখন তাঁদের ওপর। শ্রমিকদের লাইন ঠিক করা, জলের ব্যবস্থা করা, খাবার দেওয়া সবই তাঁদের ওপর। সব ঠিকঠাক করে এবার এ রাজ্যের বাসে তুলে দিতে হবে ঠিকানা মেপে মেপে। অনেকেই আবার বাসের আশায় বসে না থেকে ভাঙছেন জঙ্গল পথ।
এঁদের অনেকেরই পকেটে পয়সার অবশিষ্ট নেই।
লকডাউনের ৫০ দিন অবধি কাটাতে হয়েছে। অবশিষ্ট পয়সা গেছে বাস ভাড়ায়। মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু থেকে আসা বাস ভাড়া নিয়েছে লাখের ওপরে। ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা অবধি বাস ভাড়া গুনতে হয়েছে! সোশ্যাল ডিস্টেন্স মেনে ২০ থেকে ২৫ জনকে আসতে হয়েছে একেকজনকে। তবেই সে রাজ্য বাস ছাড়ার অনুমতি দিয়েছে। ফলে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে শুন্য হাতে, অনেককে ধার করেও। মহারাষ্ট্র থেকে পুরুলিয়ায় বাস ভাড়া করে ফিরেছেন একদল শ্রমিক। বাস ভাড়া ২.৫লক্ষ টাকা। ১০হাজার করে টাকা দিয়ে আসন কিনতে হয়েছে একেকজনকে। মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা পাঠিয়েছেন বাড়ির লোক তবেই ছেলে ঘরে ফিরেছে। এই টাকা শোধ করতে ফের ভিন রাজ্যেই যেতে হবে কারন গত এক দশকে এমন নতুন করে কোনও ব্যবস্থা হয়নি যাতে এখানেই থেকে যেতে পারত ওরা।
বাড়ি ফেরার পর সরকার বলেছে ১৭দিন হোম কোয়ারেন্টাইন। ৮ জনের সংসার, একই ঘরে থাকে।হোম কোথায়? কয়েকদিন আগে বেলপাহাড়ীর বামুনডিহা, কেচন্দা সহ কয়েকটি গ্রামে ঝড়ে উড়ে গেছে কত বাড়ির চাল। তাঁদের অনেকেরই একটা সরকারি তার্পোলিন জোটেনি তো হোম কোথায়? যদিও বা কারও কারও হোম জোটে ঘরের লাগোয়া গোয়ালে তো গ্রামের লোক ভয়ে তাঁদের গ্রামেই ঢুকতে দেয়না। সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল ইত্যাদি খুলে দেওয়া যেত, দু’এক জায়গায় তেমনটা হয়েছে কিন্তু বেশিরভাগ মানুষরেই তা জোটেনি। জঙ্গলেই তাই নিভৃত বাসে জঙ্গলমহল।