নিজস্ব সংবাদদাতা: একটা গল্প দিয়েই বরং শুরু করা যাক খড়গপুরের এই গৃহবধূদের কথা। না, গল্প নয়, এটা ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে হিটলারের দানবীয় নাৎসি সেনারা যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করতে ঢুকে পড়েছে তখন তাঁদের বিশ্বজুড়ে অপরাজেয়র খ্যাতি। মিত্রশক্তির অন্যতম দুই দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন সোভিয়েত রণাঙ্গনে কার্যত দর্শকের ভূমিকায় থেকে নাৎসি বাহিনীর বল আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মনে প্রানে চাইছে হিটলারের হাতে ধ্বংস হয়ে যাক সোভিয়েত। প্রাথমিকভাবে ব্যাপক হতাহতের সংখ্যা সোভিয়েত শিবিরে। উল্লাসে ফেটে পড়েছে নাৎসি বাহিনী কিন্তু কয়েকদিন যেতেই এক অবাক করা কান্ড মাথা ঘুরিয়ে দিল জার্মান সেনাদের। এত মারছে, রক্তাক্ত করছে তবুও প্রতিদিনই নতুন নতুন ঝকঝকে তকতকে ইস্ত্রি করা পোশাক পরে হাজারে হাজারে সোভিয়েত সেনা আসছে কোথা থেকে? হ্যাঁ, এই সেই যুদ্ধ, ইতিহাস যাকে চেনে স্তালিনগ্রাদের লড়াই নামে। এই যুদ্ধই শেষ অবধি কোমর ভেঙে দিয়েছিল হিটলার এবং তার নাৎসিবাহিনীর। এই যুদ্ধই শেষ অবধি বর্বরতার অবসান ঘটিয়ে ইউরোপকে রক্ষা করল নাজি আগ্রাসনের হাত থেকে, এই যুদ্ধই হিটলারের পতন আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের কারন। সেদিন ক্রমাগত মার খেতে থাকা সোভিয়েত বাহিনীকে প্রতিদিনই নতুন ঝাঁ চকচকে পোশাকের যোগান দিয়েছিলেন সোভিয়েত গৃহবধূরাই। পরিবারের জামা কাপড়ের সাথেই প্রতিদিন তারা কেচে ইস্ত্রি করে রণাঙ্গনে পাঠাতেন দু’তিন সেট করে সেনাদের পোশাক, আগের রাতে যা দুমড়ে মুচড়ে রক্তাক্ত হয়ে আসত তাঁদের বাড়িতে। প্রতিদিন যুদ্ধে যাওয়ার আগে এই পোশাক গায়ে পরে সোভিয়েত সেনারা মনে করতেন যুদ্ধটা জিততে না পারলে পরাজিত সোভিয়েতে তাঁদের এই মায়েরা, বোনেরা দাসী হয়ে যাবে হিটলার বাহিনীর। এভাবেই একটি নারী জাতি একাত্ম হয়ে গিয়েছিল স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে। সে লড়াই জিতবে হিটলারের সাধ্য কী? হ্যাঁ, লড়াইয়ের এই নিজস্ব ফ্রন্ট নিজেরাই খুঁজে নিয়েছিলেন সোভিয়েত রমণীরা। ঠিক যেমনটা আজ, এই করোনা যুদ্ধে, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিজস্ব লড়াই খুঁজে নিয়েছেন খড়গপুরের গৃহবধূরা।
এই মুহূর্তে সমগ্র খড়গপুর শহর জুড়ে মোট ৩০জন গৃহবধূ তাঁদের রান্নাঘর থেকে নিজের হাতে রান্না করা খাবার পাঠাচ্ছেন করোনা আক্রান্ত সেই সমস্ত পরিবারে যেখানে সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ায় রান্না করার কেউই নেই। খড়গপুর শহরের দুটি সংস্থা ভগৎ সিং জন্ম শতবার্ষিকী কমিটি এবং শঙ্খমালার উদ্যোগ ও সহযোগিতায় খড়গপুর গৃহিণীদের এই রান্না করা খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে আক্রান্তদের বাড়ি বাড়ি। ভগৎ সিং জন্মশতবার্ষিকীর কেন্দ্রীয় অফিস শহরের দক্ষিণে তালবাগিচা কিংবা শঙ্খমালার দপ্তর শহরের উত্তরপ্রান্ত ইন্দা এলাকাতে হলেও দুপক্ষের সদস্যরাই গৃহিণীদের রান্না করা খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন পুরো শহর জুড়েই, যখন যেখান থেকে অনুরোধ আসছে। আর দশভূজা গৃহিণীর দল তাঁদের হেঁসেল খুলে দিয়েছেন হিজলী সোসাইটি প্রেমবাজার, ডিভিসি মায়াপুর, ততালবাগিচা, মালঞ্চ, সুভাষপল্লী, ইন্দা, নিউটাউন, ট্রাফিক, বুলবুলচটি, সাঁজোয়াল সহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় নিজ নিজ ঘরে।
শঙ্খমালার সম্পাদক কৃশানু আচার্য্য এবং ভগৎ সিং শতবার্ষিকী কমিটির সম্পাদক প্রদ্যোৎ দাশগুপ্তরা জানিয়েছেন, “করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত এই শহরে মারাত্মক পারিবারিক সংক্রমন দেখা দিয়েছে। একেকটি পরিবারের সমস্ত সদস্য আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। এমনই অবস্থা হচ্ছে তাঁরা রান্না করতে পারছেননা। এই পরিস্থিতিতে আমরা আহ্বান জানিয়েছিলাম যদি কারো বাড়িতে রান্না করা খাবারের প্রয়োজন হয় তবে আমরা তাঁদের বাড়িতে রান্না করা খাবার পৌঁছে দিয়ে আসব। প্রথমে অল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম কারন তখন ভাবনা ছিল কারা এই রান্না করে দেবেন। এখন এতজন গৃহিণী এগিয়ে এসেছেন যে আমরা এটা কল্পনাও করতে পারিনি।” ভগৎ সিং শতবার্ষিকী কমিটির হয়ে নিজেদের রান্না করছেন ১৯ জন গৃহবধূ অন্যদিকে শঙ্খমালার হয়ে রান্না করছেন ১২জন। সবচেয়ে বড় কথা এরা নিজেদের সংসারের চাল ডাল মাছ ডিম ব্যবহার করছেন। কোনও গৃহবধুই এই রান্নার সামগ্রী নিচ্ছেননা কমিটির কাছ থেকে।
কৃশানু জানিয়েছেন, “আমরা অভিভূত গৃহিণীদের এই স্বতঃস্ফূর্ততায়। সবাই চাইছেন কোনোও না কোনও পরিবারের রান্নার দায়িত্ব তাঁদের দেওয়া হোক। আমাদের কাছে যেমন অনুরোধ আসে আমরা তেমনই অনুরোধ জানাই গৃহিণীদের কাছে। এখন আমাদের ১২জন রান্না করছেন। হয়ত ১০টি পরিবারের রান্নার অনুরোধ পেলাম। স্বাভাবিক ভাবেই ২জনকে রান্না দিতে পারলাম না। তখন তাঁদের অভিমান হচ্ছে।” কৃশানুরা এই উদ্যোগ শুরু করেছিলেন ১৪ই মে, ১টি পরিবারে ২জন সদস্যের ২বেলার রান্না দিয়ে। অর্থাৎ প্রথম দিন দুবেলায় ৪টি মিল দিয়েছিলেন তাঁরা। ২৭শে মে সেই মিলের পরিমান দাঁড়িয়েছে ৩৮টিতে। এখনও অবধি ৪১০টি মিল দিয়েছেন তাঁরা।
অন্যদিকে ভগৎ সিং জন্মশতবার্ষিকী কমিটি রান্না করা খাবার পরিবেশন শুরু করেছিল ১৭ই মে, ২টি পরিবারে দুবেলা ৪টি মিল দিয়ে। বর্তমানে ৬টি পরিবারে দুবেলা ২০টি মিল পৌঁছে দিচ্ছে তাঁরা। দুটি সংগঠন মিলে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন ইন্দা, রবীন্দ্রপল্লী, দিনেশনগর, তালবাগিচা, প্রেমবাজার সোসাইটি, আইআইটি, মালঞ্চ, খরিদা, সুভাষপল্লী, ঝাপেটাপুর, কৌশল্যা যখন যেখান থেকে অনুরোধ আসছে। দুই সংগঠনের সদস্যরা বাইক অথবা সাইকেলে করে গৃহিণীদের কাছ থেকে খাবার সংগ্ৰহ করে পৌঁছে দিচ্ছেন করোনা আক্রান্তদের বাড়িতে বাড়িতে।
খাবারের পুষ্টিগুণ, স্বাদ ইত্যাদি নিজেদের মতই করে নিচ্ছেন গৃহিণীরা। এঁদের কেউ শিক্ষিকা, কেউ গায়িকা, আবৃত্তিকার। কেউ নিছকই গৃহবধূ। নিজেদের পরিবারের সঙ্গেই বাড়তি চাল ডাল শাকসবজি মাছ ডিম নিয়ে নিচ্ছেন। যখন যেমনটা নিজেদের জন্য রান্না করছেন তাই পাঠাচ্ছেন আক্রান্ত পরিবারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমনই এক গৃহিণী জানালেন, ” চিকিৎসক বা নার্স নই আমরা তবুও এই করোনা যুদ্ধে আমরাও যে আমাদের মত করে সামিল হতে পারব এটা প্রথমদিকে ভাবিনি। ভেবেছিলাম অন্য অনেকের মতই শুধু ঘরে থাকাটাই বোধহয় লড়াই কিন্তু এই অভিজ্ঞতা আমাদের গর্বিত করেছে। করোনা যুদ্ধে এখন আমরাও সৈনিক আর আমাদের রান্নাঘর থেকেই সেই লড়াইটা করছি আমরা। খুব ভালো লাগছে এই কাজটা করতে।” এরপর করোনা না হেরে যাবে কোথায়?