নিজস্ব সংবাদদাতা: ফের ফিরে এল সেই রাফালের ভূত। যে রাফাল যুদ্ধ বিমান কেনাবেচা নিয়ে বারবার অভিযোগের আঙুল উঠেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে। যে রাফাল মামলা কোর্টে উত্থাপিত হওয়ার পরই প্রতিরক্ষা মন্ত্রক থেকে হারিয়ে গেছিল চুক্তি সংক্রান্ত নথি। ২০১৮-১৯ রাফাল নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল দেশ। এবার সেই একই অভিযোগ, রাফাল যুদ্ধ বিমান কেনার ব্যাপারে ১ মিলিয়ন ইউরো লেনদেনে জড়িত আছেন এমনই অভিযোগ এনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে দেশের সঙ্গে প্রাতরনা, বিশ্বাসভঙ্গ ও অপরাধের জনস্বার্থ মামলা দায়ের করতে চেয়ে সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হলেন এক ব্যক্তি।
মনোহর লাল শর্মা নামে ওই আবেদনকারী একই সাথে রাফাল লেনদেনের মধ্যস্থাকারি সুশেন গুপ্তার বিরুদ্ধেও একই মামলা দায়ের করার আবেদনের পাশাপাশি ঘটনায় সর্বোচ্চ আদালতের তত্ত্বাবধানে সিবিআই তদন্তেরও আবেদন জানিয়েছেন। উল্লেখ্য এপ্রিলের ৫তারিখে ফ্রান্সের দুর্নীতি প্রতিরোধ সংস্থা এ এফ এ AFA জানায় যে রাফাল যুদ্ধ বিমান নির্মাণকারী সংস্থা দ্যজাল্ট আ্যভিয়েশন সুশেন গুপ্তাকে ১ মিলিয়ন ইউরো দিয়েছিল এই লেনদেনের জন্য। এই তথ্যকে সামনে রেখেই শর্মা ৬ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টে এই জনস্বার্থ মামলা গ্রহণ করার জন্য আবেদন করেন যা প্রকাশ্যে এসেছে গত রবিবারই। আশা করা যাচ্ছে আগামী সপ্তাহে এর শুনানি হতে চলেছে।
ওই আবেদনে বলা হয়েছে, ” ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ওই এজেন্সি ফ্রানসাইজ আ্যন্টিকোরাপশন বা AFA হল ভারতের কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেললের (ক্যাগ বা CAG) সমান যাদের কাজ হল ফ্রান্সের বিভিন্ন কোম্পানিগুলি ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে বেনিয়ম,অনিয়ম ও দুর্নীতি করছে কিনা তারওপর নজরদারি করা। এটি ফ্রান্সের দুর্নীতি বিরোধী আইন মোতাবেক কাজ করে থাকে। এই AFA ই রাফাল লেনদেনের অডিটের জন্য নিযুক্ত ছিল এবং এরাই প্রকাশ্যে আনে যে ওই আ্যভিয়েশন কোম্পানি ভারত যাতে এই যুদ্ধ বিমান কেনে তার জন্য ১মিলিয়ন ইউরো উপহার বা ঘুষ হিসাবে দিয়েছিল।
উল্লেখ্য এর আগে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসেও এই একই বিষয় উত্থাপিত হয়েছিল সর্বোচ্চ আদালতে কিন্তু তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ ও বিচারপতি সঞ্জয় কিষান কউল এবং বিচারপতি কে এম জোসেফ রাফাল লেনদেনের মামলাটিতে আদালতের হস্তক্ষেপ বাঞ্চনীয় বলে জানিয়ে দেন। পাশাপাশি আদালতের আওতায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশও দিতে রাজি হননি। এরপর ২০১৯ সালে আদালতের এই নির্দেশকে পুনর্বিবেচনা করার জন্য একগুচ্ছ আবেদন জমা করা হলেও সর্বোচ্চ আদালত তা বাতিল করে দেয় কারন সেই সময় এই লেনদেন সংক্রান্ত বেশকিছু নথি মামলা চলাকালীন আদালতের হেফাজত থেকে হঠাৎই লুকিয়ে ফেলা হয়।
যদিও বিচারপতি জোসেফ রায় দান করতে গিয়ে বলেছিলেন আবেদনকারীদের মামলা বাতিল করলেও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইকে আদালত পূর্ন স্বাধীনতা দিচ্ছে যদি তারা মনে করে তাহলে এফআইআর দায়ের করে মামলা দায়ের করে তদন্ত চালিয়ে যেতে পারে। বলাবাহুল্য ‘সরকারের তোতাপাখি’ বলে নিন্দিত সিবিআই সে পথে হাঁটেনি। এবার আদালতের কাছে শর্মা দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং সুশেন গুপ্তার বিরুদ্ধে মামলা কয়েকটি ধারায় মামলা দায়ের করতে চান তিনি। মামলার ধারাগুলি হল ভারতীয় দন্ডবিধির ৪০৯ ধারায় জনপ্রতিনিধি হওয়া স্বত্ত্বেও অপরাধ মূলক বিশ্বাসভঙ্গ যা প্রমাণিত হলে ১০ বছরের জেল , ৪২০ ধারায় প্রতারনা যার সাজা ৭ বছর অবধি জেল এবং ১২০ বি ধারায় অপরাধ মূলক ষড়যন্ত্র যা প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
অভিযোগগে শর্মা বলেছেন, মোদি এবং গুপ্তা মিলেই সরকার ও সিবিআইকে উপেক্ষা করে পেছনের দরজা দিয়ে দ্যাসল্ট রিলায়েন্স এ্যরোস্পেস লিমিটেড তৈরি হতে সাহায্য করেছেন। তাঁর আরও দাবি এর আগে যে অভিযোগগুলি আদালত প্রত্যাখ্যান করেছে তার ফলে সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাগরিকদের জীবনকে রক্ষা করা এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। ১৩ নম্বর ধারায় নাগরিকদের মৌলিক আধিকারিকগুলিকে অবজ্ঞা করা হয়েছে এবং ২৫৩ ধারায় ভারতীয় আইনে যে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলির ওপর আইনি নজরদারি ব্যবস্থা খর্ব করা হয়েছে।
মনোহর লাল শর্মা আদালতের কাছে বিবেচনার জন্য কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপিত করেছেন। তিনি জানতে চেয়েছেন রাফাল চুক্তি প্রসঙ্গে উৎকোচ নেওয়ার বিষয়টি আদালতে আসার পরই প্রতিরক্ষা মন্ত্রক থেকে চুক্তি সংক্রান্ত দলিলের যে অংশ চুরি হয়েছিল তারজন্য কাউকে আজ অবধি শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে কী? এই গোপনীয় ফাইল হারানোর জন্য কাউকে দায়ি করে সরকারি দপ্তরের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের দায়ে ৩ নম্বর ধারায় বা ১৯৮৮ সালের দুর্নীতি বিরোধী আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কী? রাফাল চুক্তি কী দুটি দেশের মধ্যে চুক্তি বলেই গণ্য করা হবে নাকি জাতি সংঘ সনদের আওতায় এটি একটি বৈধ চুক্তি বলে গ্রহণ করা হবে?
উল্লেখ্য তৎকালীন ইউএপিএ সরকারের আমলে রাফাল চুক্তি হলেও পরবর্তীকালে মোদি সরকারের আমলে এই চুক্তির রদবদল করে আগের চেয়ে অনেক বেশি দামে রাফাল বিমান কেনার অভিযোগ ওঠে। পাশাপাশি চুক্তি সংক্রান্ত যে সুবিধা পরবর্তী কালে সরকারের অধীনস্ত হিন্দুস্তান আ্যরোনোটিকেলের পাওয়ার কথা ছিল তা আম্বানীদের পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। যদিও মোদি এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন। গত কয়েকবছর মামলাটি ধামাচাপা পড়ে গেলেও সম্প্রতি ফ্রান্সের ওই দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা মোদির আমলের লেনদেনে ঘুষ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়ে দেওয়ার পর ফের একবার রাফাল ভূতের প্রত্যাবর্তন ঘটল মনে করা হচ্ছে। এবারও জল অনেকদূর গড়াতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে।