জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৯৪
চিন্ময় দাশ শিব মন্দির, বিষড়া (মেদিনীপুর কোতয়ালী থানা)
এক নষ্ট-মেয়ের কীর্তি-কথা নিয়ে আজকের জার্নাল। রূপের কল্যাণে রুপোর সঞ্চয়। রাজপুরুষদের মনোরঞ্জন করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হয়েছিল সেই রমণীর। পতনের পাপ মুছতে, শরণ নিয়েছিলেন মহাদেবের। উঁচু মাথার মন্দির গড়ে, স্থাপন করেছিলেন মহাদেবকে।
এই পতিতার কাহিনী জুড়ে আছে বাংলা তথা মেদিনীপুর জেলার ইতিহাসের সাথে। যার সূচনা হয়েছিল মেদিনীপুর জেলায় ইংরেজের অধিকার পত্তনের মাধ্যমে। সেকারণে, একবার পিছন ফিরে তাকাতে হবে আমাদের।
১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর, মীর জাফর খাঁকে নবাবের পদে বসায় ইংরেজরা। পরে, ১৭৬০ সালে, তাঁকে হটিয়ে মীর কাসেম আলীকে সেই পদে বসালে, চট্টগ্রামের একটি থানা, চাকলা বর্ধমান এবং চাকলা মেদিনীপুর-এর অধিকার ইংরেজকে ছেড়ে দেন তিনি। তার ৫ বছর পরে, ১৭৬৫ সালে, নবাব নজম-উদ্দৌলা নিজের মাসোহারার বিনিময়ে, পুরো বাংলা রক্ষার ভার ইংরেজকে সমর্পন করে দেন। সেই বছরেই দিল্লীর বাদশাহও জায়গীর হিসাবে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানী ক্লাইভের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
একেবারে প্রথম পর্বে ভূমি রাজস্ব বা জমির খাজনাই ছিল বাংলা থেকে ইংরেজের সম্পদ লুন্ঠনের প্রধান উৎস। জমিদার আর তালুকদাররা রাজস্ব আদায়ের কাজ করতেন। ১৭৯৩ সালে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা’ প্রচলন করেন বড়লাট কর্ণওয়ালিশ। সেই আইনের সুবাদে, নিজেরাই একটি জমিদারী প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজরা। নাম হয়– মেদিনীপুর জমিদারী কোম্পানী লিমিটেড। অতি দ্রুত বিশাল আয়তনে গড়ে উঠেছিল কোম্পানিটি। বিস্তার ঘটেছিল গোটা জেলা জুড়ে।
জমিদারী কাজের প্রধান দপ্তর হোল কাছারী। জেলার পশ্চিম এলাকায় গোদাপিয়াশাল, বেলপাহাড়ী, নয়াগ্রাম ইত্যাদি স্থানে কয়েকটি বড় মাপের কাছারী ছিল কোম্পানির। সেগুলির প্রতিটির অধীনে আবার কয়েকটি করে ছোট কাছারী। তেমনই একটি ছোট কাছারি ছিল মেদিনীপুর সদর কোতোয়ালী থানার বিষড়া গ্রামে। সেটি ছিল গোদাপিয়াশাল কাছারীর অধীন।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি সময়। বাংলায় তখন ইংরেজের অপরিসীম আধিপত্য। জমিদারী কোম্পানীও চলছে রমরমিয়ে। বিষড়ার কাছারী ছোট হলেও, শ্বেতাঙ্গ সহ বহু রাজপুরুষের নিয়মিত আনাগোণা সেখানে। বিষড়া গ্রামে বাস ছিল এক অপরূপ সুন্দরী যুবতীর। অভাবী বাড়ীর কন্যা। পা পিছলাতে সময় লাগেনি তাঁর।
মেদিনীপুর শহর, মেদিনীপু মহালের জমিদারের রাজধানী কর্ণগড়, আর, কর্ণগড়ের শেষ রানি শিরোমণির পিত্রালয় শিরোমণি গ্রাম– এই তিনের মাঝখানে বিষড়া গ্রাম। বিষড়া ছাড়াও, লাগোয়া শিরোমণি, ধর্মপুর ইত্যাদি গ্রামে বেশ কয়েকটি সম্পন্ন পরিবারের বসবাস ছিল। বিলাসিতা আর নারীসংসর্গে কেউই কম যেতেন না তাঁরা। কাছারীর রাজপুরুষরা ছাড়া, সেই বাবুরাও হাজির হতেন রূপসীর দরজায়।
জীবনকথা জানা গেলেও, সেই রূপসী রমণীর নামটি আজ আর স্মরণে নাই কারও। হারিয়ে গিয়েছে বিস্মৃতির অতলে। এলাকার লোকজনের মুখে মন্দিরটির নাম– ‘বেতি নাড়ী’-র মন্দির। বাংলা অভিধানে ‘রাঁড়’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। সাহিত্য সংসদ- এর ‘বাঙ্গালা অভিধান’ এবং সুবল চন্দ্র মিত্র-এর ‘সরল বাঙ্গালা অভিধান’-এ অর্থ বলা হয়েছে– বিধবা, বেশ্যা, রক্ষিতা, উপপত্নী। সাহিত্য অকাদেমি -র ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ (হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়) -এ বিধবা এবং বেশ্যা ছাড়াও, রাঁড় শব্দের আর একটি অর্থ বলা হয়েছে– গৃহস্থের ব্যভিচারিণী স্ত্রী। গ্রামদেশে এইসকল শ্রেণীর রমণীকেই ‘রাঁড়’ নামে উল্লেখ করা হয়। এখানেও নষ্ট-মেয়ে বা পতিতা হিসাবেই তাঁকে রাঁড় নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমাদের অনুমান, ‘বেতি’ হয়ত তাঁর নামের অপভ্ৰংশ , কিংবা ডাক-নাম। নামের নিশ্চিত উৎস সন্ধান করা যায়নি। আজ আর তা নিয়ে গ্রামবাসীরা তেমন ভাবিতও নন।
যাইহোক, সেই মন্দ মেয়ে অচিরেই প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। তা দিয়েই তিনি মহাদেব শিবের এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। বড় আকারের একটি জলাশয়ও খনন করেছিলেন দেবতার জন্য। দেবসেবার জল নেওয়া হবে, সেকারণে, শাস্ত্রীয় বিধান মেনে, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জলাশয়টি। ‘শিব পুকুর’ নামে পরিচিত সেই জলাশয়ের পাড়েই মন্দিরটি অবস্থিত।
আড়ে-বহরে তেমন বড় নয় মন্দিরটি, তবে তেমন ছোটও নয়। উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট। উল্লেখ করবার মত কয়েকটি বৈশিষ্ট আছে দক্ষিণমুখী মন্দিরটির। এক-দুই করে বলা যেতে পারে—
১. কেবল ইট বা কেবল পাথরে গড়া নয় এটি। মন্দিরে ইট এবং পাথর দুইই ব্যবহার করা হয়েছে উপাদান হিসাবে।
২. মন্দির স্থাপিত হয় একটি মজবুত ভিত্তিবেদী বা পাদপীঠের উপর। এখানে সেই অংশটি দুটি পৃথক অংশ হিসাবে নির্মিত হয়েছে– ক) মাটির গভীর থেকে গড়ে তোলা ভিত্তিবেদী। খ) সেটির উপরে আলাদাভাবে গড়া পৃথক পাদপীঠ। এমনটি প্রায়শই দেখা যায় না।
৩. এই ভিত্তিবেদী এবং পাদপীঠ দুটি অংশেরই উপাদান, গড়ন এবং পরিমাপ পৃথক পৃথক। ভিত্তিটি চতুস্কোণ এবং বর্গাকার। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১২ ফুট হিসাবে। পাথরের ব্যবহার হয়েছে এই অংশের নির্মাণে। মন্দিরের বাকি সিংহভাগই ইটের তৈরী। এর উপরেই পাদপীঠ অংশটি গড়া। সেটি কিন্তু বর্গাকার নয়। সেটি গড়া হয়েছে আট-কোণা করে। প্রতি বাহুর মাপ ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি হিসাবে।
৪. ভিত্তিবেদী আট-কোণা হলেও, মূল মন্দির কিন্তু বর্গাকারে গড়া। দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ দুইই ১০ ফুট হিসাবে।
৫. এবার লক্ষ্যণীয় সৌধটির ভিতরের গড়ন। বাইরের অংশ চতুস্কোণ বর্গাকার হলেও, এর গর্ভগৃহ সহ অভ্যন্তর অংশটি গড়া হয়েছে পাদপীঠের মত আট-কোণা হিসাবে। ফলে, গর্ভগৃহের আটটি দেওয়াল ক্ৰমশঃ উর্ধ্ব মুখী হয়ে একটি বিন্দুতে মিলিত হয়েছে।
সাধারণ পাঠক-পাঠিকা এত বিশ্লেষণে ক্লান্ত হয়ে পড়তেই পারেন। তবে, স্থাপত্যপ্রেমী পাঠকমাত্রেই মন্দিরটির এই বৈশিষ্ট সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন– এমনটাই আমাদের আশা।
ফুট আড়াই উঁচু পাদপীঠের উপর শিখর-দেউল রীতির মন্দির। চার দিকের দেওয়ালে ‘সপ্ত-রথ’ বিভাজন দেখা যায়। মাঝখানে প্রশস্ত রাহাপাগ। দুই কোণে দুটি কণকপগ। আর, এই দুইয়ের মাঝখানে দু’দিকে দুটি করে চারটি অনর্থপগ। এই নিয়ে সপ্ত-রথ বিন্যাস। মন্দিরে উঠবার সিঁড়িটি দু’দিকে স্তম্ভ স্থাপন করে নির্মিত হয়েছিল। এখন কেবল চিহ্নটুকুই চোখে পড়ে মাত্র।
উপরে শীর্ষক অংশ ক্রমান্বয়ে বেঁকি, আমলক, ঘন্টা, কলস, ত্রিশূল দিয়ে সাজানো। কলসের গড়নটি চোখে পড়বার মত। উল্লেখ করবার বিষয় হল, মন্দিরে কোনও অলঙ্করণ নাই। তবে, এই শীর্ষক এবং পরিত্যক্ত সমগ্র মন্দিরটিই দ্রুত ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে।সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী অমলেন্দু ভট্টাচার্য্য, শ্যামসুন্দর বক্সী– শিরোমণি। স্বপন রায়, শশাঙ্ক পাত্র– বিষড়া।
যাওয়া-আসা : মেদিনীপুর শহরের এল. আই. সি. চক থেকে নিয়মিত অটো রিক্সা চলাচল করে গ্রামের উপর দিয়ে। দূরত্ব ৮ কিমি। শহরের কাঁসাই নদীর উপর বীরেন্দ্র সেতু থেকে উত্তরমুখে ধৰ্মা এবং কেরাণী চটি-র মাঝখানে গিরিধারী চক। সেখান থেকে পূর্বমুখী পথে, শিরোমণি পার হয়েই বিষড়া গ্রামটির অবস্থান।