নিত্য গুপ্ত: বহুদিন যেন পুলিশ দেখেনি বাংলা! নিরপেক্ষ, নির্ভিক পুলিশ। আর আইপিএস আধিকারিক? না, দময়ন্তী সেন, মনোজ ভার্মাদের পর বাংলায় তেমন আইপিএস আধিকারিক খুব একটা নজরে পড়েছে কী? নিশ্চয় আছেন কিন্তু আড়ালে। না হলে নগেন্দ্র ত্রিপাঠী এলেন কোথা থেকে? কম্পলসারি ওয়েটিং নয়ত পাহাড় জঙ্গলে বদলির ভয়ে জুজু হয়ে থাকা পুলিশ আধিকারিকরাই কী আইপিএস আধিকারিক? ‘আপনাদের চাবকানো উচিত।’ সেই প্রথম দিকেই বইমেলার ভিড়ে আটকে পড়া মুখ্যমন্ত্রী যখন প্রকাশ্যে এক আইপিএস আধিকারিককে এই কথা বলার পর থেকেই পুলিশ উধাও হয়ে গেছিল কী? তারপরই কী পুলিশ চলে গেল টেবিলের তলায় কিংবা কেস ফাইলে নিজের মুখ আড়াল করে? কিন্তু ১লা এপ্রিল ২০২১, নন্দীগ্রামের বয়াল-২ য়ের ৭ নম্বর বুথে এক আইপিএস আধিকারিক জানিয়ে দিলেন অশোকস্তম্ভ কাঁধে রাখা সব আইপিএস আধিকারিকই ট্রান্সফার কিংবা কম্পলসারি ওয়েটিংয়ের ভয়ে শাসকের হ্যাঁ তে হ্যাঁ কিংবা না তে না মিলিয়ে পুবের সূর্য পশ্চিমে ওঠায় না। কেউ কেউ আইপিএস হয়ে আইপিএসই থেকে যান, রঙ লাগিয়ে খাঁকি উর্দি রঙিন করে দেননা।
বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা ভোটে যে ৩০ আসনে ভোটগ্রহণ হয়েছিল তার মধ্যে নজর কাড়া আসনটি ছিল নন্দীগ্রাম। অবশ্য শুধু ৩০টি কেন বলা যেতেই পারে ভোটের শুরু থেকেই ২৯৪ বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে এই আসনেই নজর ছিল সারা বাংলা তথা ভারতের। কারন এক, এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারন দুই, মুখ্যমন্ত্রীর বিপরীতে রয়েছেন তাঁরই একদা মন্ত্রিসভার সদস্য বর্তমান বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। কারন তিন, অনেকের মতে স্থানের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই নন্দীগ্রাম। ১৪ বছর আগে বাংলার শিল্প সম্ভাবনার কফিনে শেষ দুটি পেরেক পোঁতা হয়েছিল তার একটি যেমন সিঙ্গুর, অন্যটির নাম নন্দীগ্রাম। কৃষি জমি অধিগ্রহণ করে শিল্প কারখানা তৈরির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আগে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পথ করে নিয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়।
দ্বিতীয় দফার ভোটে এই নন্দীগ্রামেই সকাল থেকেই নন্দীগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় থেকে অশান্তির খবর আসছিল। তৃণমূলের তরফে অভিযোগ ওঠে তাদের এজেন্টদের বুথে ঢুকতে দেয়নি বিজেপির কর্মীরা। এছাড়াও ভোট লুটেরও অভিযোগ ওঠে বিজেপির। দুপুরের দিকে নিজের রেয়াপাড়ার ভাড়া বাড়ি থেকে এখানেই পৌঁছে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিযোগ করতে থাকেন রিগিংয়ের। আর তিনি পৌঁছানোর সাথে সাথে তাঁর উৎসাহী কর্মীরাও জড়ো হয়ে যান বুথের এক পাশে পাল্টা জমায়েত করে বিজেপি সমর্থকরা। দু’পক্ষের রনংদেহি মূর্তিতে উত্তপ্ত হয়ে পড়ে বয়াল। মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার কথা ভেবে নিরাপত্তা কর্মীরা তাঁকে বুথের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন। কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী আটকে থাকেন প্রায় ২ঘন্টা।
এই সময়েই পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে বয়ালের ৭ নম্বর বুথ পরিদর্শনে পৌঁছান শুধুমাত্র নন্দীগ্রামের জন্য কমিশনের নিযুক্ত পুলিশ সুপারের মর্যাদা সম্পন্ন আইপিএস আধিকারিক নগেন্দ্র ত্রিপাঠী। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে প্রশ্ন করেন কমিশনের নির্দেশ থাকা স্বত্ত্বেও বুথের ২০০মিটারের মধ্যে মানুষ জড়ো হয় কী করে? ত্রিপাঠী বলেন, ম্যাডাম, একটু আগেই এই বুথ দেখে গিয়েছি আমি তখন এই জমায়েত ছিলনা। মুখ্যমন্ত্রী প্রত্যুত্তরে বলেন, ও তো তোমাদের শেখানো থাকে যে বড় আধিকারিকরা ঘটনাস্থলে এলে, অবজারভাররা এলে সবাই সরে যাবে। ওরা চলে গেলে আবার চলে আসবে।
তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন মুখ্যমন্ত্রী এমনটা বুঝতে পেরেই বুলেট প্রুফ জ্যাকেটের তলা থেকে নিজের খাঁকি পোশাকের কলার বের করে দু’আঙুলে ছুঁয়ে আইপিএস নগেন্দ্র ত্রিপাঠী জবাব দেন, ‘ ম্যাডাম এই খাঁকি উর্দিতে কোনও দাগ নেব না।’ দু’দুবার এই কথা বলার পরেও এর পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, ‘দাগ তো অনেকেই নিয়েছে।’ জবাবে এবার দৃঢ়তার সাথে সিনিয়র আইপিএস অধিকারিককে বলতে শোনা যায়, ‘আমি নেব না ম্যাডাম’।
মুখ্যমন্ত্রী যখন তাঁকে এখানে বুথ জ্যামের প্রসঙ্গ বলেন, তখন ত্রিপাঠী কে গলার কন্ঠনালি ছুঁয়ে কসম খাওয়ার ভঙ্গিতে বলতে শোনা যায়,
এছাড়া তিনি আরও বলেন যে, ‘এখনও পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ চলছে। কোথাও ছোট ছোট ঘটনা ঘটলে, আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটেনি। বুথ জ্যামিং-এর ঘটনা সেইরকম ঘটেনি। আমরা সব নিয়ন্ত্রণ করিছি। আমরা ভোটারদের ভয় কমানোর জন্য আমরা রুটমার্চ করছি। বাইরের লোক যেন ভোটকে প্রভাবিত না করতে পারে তার জন্যও আমরা নজর রাখছি।” এরপরও মুখ্যমন্ত্রী সন্তুষ্ট হচ্ছেন না দেখে ওই আইপিএস বলেন, ‘ম্যাডাম এরপরেও যদি আপনাদের অভিযোগ থাকে তা অবশ্যই নির্দিষ্ট জায়গায় দাখিল করবেন।”
মাত্র কয়েক মিনিটের এই ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় আর তাতেই যেন হিন্দি সিনেমার কোনোও অংশ দেখছেন বলে চমকে উঠেছেন মানুষ।
বিধান রায় থেকে জ্যোতি বসু হয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পর্যন্ত পুলিশ আধিকারিক থেকে সাধারণ পুলিশ কর্মীদেরও আপনি সম্বোধন করার রেওয়াজ উঠে গেছে বাংলা থেকে। প্রকাশ্যে আইপিএস, আইএস আধিকারিকদের এখন তুমি বলে সম্বোধন করা হয়। তাঁদের স্থান এখন অধস্তন কর্মচারীর। তবুও তারই মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর সেই ‘ অনেকেরই উর্দিতে দাগ লেগে গেছে’ উক্তির মধ্যে যখন কেউ বলেন, আমি দাগ লাগতে দেবনা ম্যাডাম। তখন আবারও যেন আশা খুঁজে পায় বাংলা, একটা নিরপেক্ষ পুলিশ প্রশাসন ফিরে পাওয়ার আশা।