Homeএখন খবরক্রান্তিকালের মনীষা-৩২।। জগদীশচন্দ্র বসু, বিনোদ মণ্ডল

ক্রান্তিকালের মনীষা-৩২।। জগদীশচন্দ্র বসু, বিনোদ মণ্ডল

বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী আচার্য্য জগদীশচন্দ্র                                                      বিনোদ মন্ডল

মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব। দীক্ষান্ত ভাষণ দিচ্ছেন এক বিশ্ববন্দিত বাঙালি বিজ্ঞানী। তিনি বলছেন — সুতপুত্র কর্ণ রাজপুত্র অর্জুনকে শক্তি পরীক্ষায় আহ্বান করিয়াছিলেন — অর্জুন ঘৃণাভরে সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন — যাহার কোনো বংশ মর্যাদা নাই, রাজপুত্র তাহার সহিত অস্ত্র বিনিময় করবেন না। তার উত্তরে কর্ণ বলেছিলেন — ‘আমি আমার বংশের প্রতিষ্ঠাতা, আমার কার্যই আভিজাত্যের পরিচয়। এরপর বক্তার আত্মলব্ধ অভিমত — ‘নিজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে মানুষের নিজের অধিকারের দাবী বোধহয় এই বিশ্বে সর্বপ্রথম এটাই’। এই তেজস্বী প্রতিভাধর হলেন আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসু (৩০ নভেম্বর ১৮৫৮ — ২৩ নভেম্বর ১৯৩৭)।

তখনকার ঢাকা জেলার বিক্রমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ভগবানচন্দ্র বসু ও মা বামাসুন্দরী দেবী। সেই সময় তাঁর বাবা ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি ছিল সরকারি চাকরির প্রচুর চাপ ও ব্যস্ততা। তাই বলে ছেলের ভবিষ্যৎ জীবন গঠনে যত্ন ও নজরদারির ত্রুটি রাখেননি তিনি। শিশু সন্তানকে বাংলা মাধ্যমে পড়ানোর জন্য গ্রামীণ এলাকায় মায়ের নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন ভগবানচন্দ্র। লাভ হল শুধু জগদীশ নয় একই সাথে আর পাঁচ-দশটা শিশু একই স্কুলে, শিক্ষার সুযোগ পেয়ে গেল।

শুধু তাই নয়, দূরদর্শী পিতা, সন্তানের সৃজনশীল শিশু মনকে উসকে দিতে একটি টেকনিক্যাল স্কুলও চালু করলেন গ্রামে। সন্ধ্যায় যাতে ছেলে সেখানে সবার সাথে বসে হাতে কলমে নানা আধুনিক যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করেন, সেদিকে ধারাবাহিক নজরদারি চলত বাবার। এর ফলে গ্রামের চালচিত্রে বদল ঘটলো। কৃষি কাজের উপযোগী সরঞ্জাম তৈরির পাশাপাশি গ্রামে কামার, কুমোর, ছুতোর, তাঁতীও পেশায় পেল আধুনিকতার ছোঁয়া।

স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলকাতায় পাড়ি। এবার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। এবার পদার্থবিদ্যা অধ্যয়ন। ভালো ফল করে লন্ডনে গেলেন ডাক্তারি পড়তে। কিন্তু স্বাস্থ্যের কারণে তা ছাড়তে হলো। ভর্তি হলেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা পাঠ সাঙ্গ করে লাভ করলেন ট্রাইপস ডিগ্রী। সম সময়ে বিশ্ব বিখ্যাত ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরীতে কাজ করেছেন আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড রালে। তাঁর গবেষণা সহায়ক হিসাবে কিছুদিন কাজ করেছেন জগদীশচন্দ্র। পাশাপাশি আত্ম শিক্ষা থেমে নেই। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করলেন ডি এস সি ডিগ্রি। কিন্তু পাশ্চাত্যের মোহময় হাতছানি তাঁকে বেঁধে রাখতে পারল না। ফিরে এলেন দেশে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন ২৭ বছর বয়সে।

ছোট গবেষণাগার। অপ্রতুল সামগ্রী। নিজে নিজে কাজের উপযোগী যন্ত্র, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সরঞ্জাম বানিয়ে কাজ চলল। এ যেন পাহাড়ি পথ কেটে কেটে এগোনোর চেষ্টা। কেটে গেল দশ দশটা বছর। ১৮৯৫ সাল। তখন তিনি ৩৭। কলকাতার ঐতিহ্য মন্ডিত টাউন হলে নিজের তৈরি কলকব্জা নিয়ে ম্যাজিক দেখাতে হাজির জগদীশ। ম্যাজিকই বটে। প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ফুট দূরে রাখা বারুদের স্তূপে টেবিলে রাখা পিস্তলের মত যন্ত্র থেকে গুলি ছোড়ার মত একটা শব্দ করলেন তিনি। দূরের বারুদ উধাও হয়ে গেল। উল্লাসে ফেটে পড়লেন সমবেত দর্শকমন্ডলী। মনে রাখতে হবে, তখনো বেতারযন্ত্র আসেনি। এক অদৃশ্য তরঙ্গ বারুদের গায়ে ধাক্কা মারলো সেদিন। আবিষ্কৃত হল – ‘মাইক্রো ওয়েভ ‘।

এখন পেটেন্ট করবার জন্য গবেষকরা কোন কোন কাজ করেন, তার নানা কীর্তিকাহিনী জনমানসে সুবিদিত। অথচ ১৮৯৬ থেকে ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্সে নিজের আবিষ্কার এর বিষয়ে জানিয়ে নানা বক্তৃতা করেছেন, তার পেটেন্ট পেলেন মার্কনী সাহেব। তাও ১৯০০ সালের ২৬ এপ্রিল। পেটেন্ট নং ৭৭৭৭। পেটেন্ট দাবি করেননি, কিন্তু নানা বক্তৃতায় বুঝিয়ে দিয়েছেন – আবিষ্কার তাঁর। কেননা বহু যশস্বী বিজ্ঞানী সেসব সেমিনারে উপস্থিত থেকে তাঁর আলোচনার পরে অভিমত প্রকাশ করে বক্তব্য রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে দুজনের নাম উল্লেখ করি।
ইলেকট্রন আবিষ্কারক জে. জে. থমসন। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন। প্যারিসে আয়োজিত এমনই এক সভায় আলো করে শ্রোতৃমন্ডলীতে আসীন ছিলেন তরুণ সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ।

কিন্তু প্রশ্ন জাগে, কেন তিনি পেটেন্ট করানোয় অনাগ্রহী ছিলেন? অনুজ বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে জগদীশচন্দ্র বলেছেন — আমার বক্তৃতার কিয়ৎক্ষণ পূর্বে একজন অতি বিখ্যাত telephone কোম্পানির ক্রোড়পতি proprietor, টেলিফোন করিয়া জানাইলেন, আপনার সঙ্গে দেখা করিবার বিশেষ দরকার। আমি লিখিলাম, সময় নাই। তার উত্তর পাইলাম, আমি নিজেই আসিতেছি। অল্পক্ষণের মধ্যেই স্বয়ং উপস্থিত proprietor, হাতে Petent form. আমাকে বিশেষ অনুরোধ করিলেন, আপনি আজ বক্তৃতায় সব কথা খুলিয়া বলিবেন না……..। আমি যে কাজ লইয়া আছি, তাহা বাণিজ্যের লাভালাভের ওপরে নয়। আমার জীবনের দিন কমিয়া আসিতেছে। আমার যাহা বলিবার তাহারও সময় পাইনা। আমি অসম্মত হইলাম।

পশ্চিমের জয়মাল্য গলায় পরে যেদিন দেশে ফিরলেন, হাওড়া স্টেশনে বাংলার মনীষী কুল অভিনন্দন জানাতে হাজির ছিলেন। ছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। ডঃ নীলরতন সরকার। সমাজ সংস্কারক শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তাঁর সাধের প্রেসিডেন্সি তাঁর প্রতি কখনো সদয় হয়নি। লর্ড ব্যালে ভারতে এসে তাঁর কলেজে তাঁর গবেষণাগার দেখতে যান। সে খবর শুনে ঈর্ষান্বিত অধ্যক্ষ শোকজ করেছিলেন তাঁকে। আমাকে না জানিয়ে তুমি কেন গবেষণাগার দেখিয়েছো এবং বলো কোন অধিকারে আমাকে না জানিয়ে এ কাজ করেছ? বিদেশ থেকে ফিরে আধুনিক গবেষণা- প্রয়োজনে সরকারের কাছে অর্থের জন্য লিখিত আবেদন করেন। সরকারি এক উপদেষ্টা পরিহাস করে বলেছিলেন — উনি এখন ৫০০ টাকা মাস মাইনে পান। তাতে কোনো সরকারী নেটিভের এ টাকায় চলছে না, বলাটা বোকামি। নীরবে এসব মেনে নেননি।প্রতিবাদে কিছুদিন বেতন নেওয়া বন্ধ করে দেন। শেষে কর্তৃপক্ষ হার স্বীকার করেন। সেই থেকে বেতন বৈষম্য দূর হলো — সাদা চামড়া আর কালো চামড়ার মেধার সমতুল্য মূল্যায়ন চালু হলো।

তাঁর গবেষণাকর্ম ছিল বিচিত্রগামী। তিনি বিদ্যুৎ তরঙ্গ গ্রাহক যন্ত্র ‘তেজোমিটার’ আবিষ্কার করেন। এটাই ছিল প্রথম সৌর তড়িৎকোষ, যাকে আমাদের চোখের সঙ্গে তিনি তুলনা করেন। উদ্ভিদ যে উত্তেজনায় সাড়া দেয় – এতো প্রমাণ করলেন তিনিই। এর জন্য আবিষ্কার করেছেন একগুচ্ছ যন্ত্র – ক্রেস্কোগ্রাফ, রেজোনেন্ট রেকর্ডার, প্ল্যান্ট ফাইটোগ্রাফ, কম্পাউন্ট লিভার ক্রেস্কোগ্রাফ।

বাস্তবিক, ‘জীব পদার্থবিদ্যার’ প্রথম রূপকার তিনি। আর শুধু বিজ্ঞান চর্চা নয়, মাতৃভাষায় বিজ্ঞান সাধনায় পথপ্রদর্শকও তিনি। তাঁর পলাতক তুফানের সাথে সাথে অনেকে অব্যক্ত গ্রন্থটির উল্লেখ করেন। যেখানে বিজ্ঞান ও সাহিত্যের অনুপম মেলবন্ধন ঘটেছে। এই সূত্রে অনেকে তাঁকে বাংলা কল্পবিজ্ঞান রচনার ভিত্তিস্থাপকের মর্যাদা দেন।

মনের মত একটি বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র ব্যবহারের সুযোগ পাননি কখনো। সেই আক্ষেপ ঘুচানোর স্বপ্ন সফল হল ১৯১৭ সালের ৩০ নভেম্বর। তিনি তখন ষাট। পরমায়ুর হীরক জয়ন্তী। প্রতিষ্ঠিত হল বসু বিজ্ঞান মন্দির। বন্ধুপ্রতিম ত্রিপুরার মহারাজা দশ হাজার টাকা পাঠিয়ে ছিলেন। নিজে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে যা পেতেন, তা লাগিয়েছেন এখানে। প্রথম পর্বে এর পরিচালন সমিতির সদস্য ছিলেন প্রেরণাদাতা বন্ধু রবীন্দ্রনাথও। জীবনে যত স্বীকৃতি, যত সম্মান, যত সংবর্ধনা লাভ করেছেন সেকালের পরাধীন ভারতে তা অপ্রত্যাশিত বটে। তাই তিনিও কখনো হেলায় কখনো খেলাচ্ছলে তা গ্রহণ করেছেন। ১৯২০ সালে রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হয়ে বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে লিখেছেন – ‘আমার একটি পুচ্ছ সংযোগ হইয়াছে’।

অক্লান্ত পরিশ্রমে অসুস্থ মানুষটি গিরিডিতে যান স্বাস্থ্য ফেরাতে। সেখানেই জীবন দীপ নির্বাপিত হয়। রেখে যান অগণিত ছাত্র-ছাত্রী, গুণমুগ্ধ, আবিষ্কৃত মেধা ফসল – যন্ত্রপাতি ও ১১ টি গ্রন্থ। যা মাতৃভাষা বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত।

RELATED ARTICLES

Most Popular