নিজস্ব সংবাদদাতা: লাগোয়া বাড়ি মনি পালের। পঁচেট গ্রামের এই গৃহবধূর চোখের জল শুকোয় না কিছুতেই। জানালেন, ‘ বিয়ে হয়ে এই গ্রামে আসার পর থেকেই দেখছি ওকে। আমার চোখের সামনে ও এর ওর ভাই জন্মেছে। আমারই তো কোলে পিঠে মানুষ যে ওরা। এখানেই মাধ্যমিক অবধি পড়াশুনা। তারপর বড় হয়ে কলকাতায় গেল বাবার কাছে। যে ছেলেটা বাড়ি এলেই, ‘কাকিমা কী রেঁধেছ বলে রান্নাঘরে ঝাঁপিয়ে পড়ত। সে ছেলেটা আর আসবেনা কোনও দিন! জানালেন,’ পঁচেটের দুর্গাপূজার চাইতেও বিখ্যাত রাসমেলা। সাতদিন নিরন্তর হৈচৈ করে গোটা পাড়া মাতিয়ে রাখত ছেলেটা।”
না, আর কোনও পূর্ণিমায় বন্ধুদের সঙ্গে রাত জাগবেনা ছেলেটা। পটাশপুর থানার পঁচেট গ্রামে এখন শশ্মানের নিস্তব্ধতা। ভোটের প্রচার জমছেনা কিছুতেই। ৮ই মার্চ, কলকাতার স্ট্যান্ড রোডে পূর্ব রেলের ১৩তলা ভবনে আগুন নেভাতে গিয়ে চার সহকর্মীর সাথে শহিদ হয়ে গেছে পঁচেটের গৌরব কুমার বেজ। গৌরবের সেই গৌরব বয়ে ভোট ভুলেছে পুরো পঁচেটই।
২৭শে মার্চ ভোট পটাশপুর বিধানসভা এলাকায়। হাতে মাত্র ১৫দিন কিন্তু প্রচারের তাপ উত্তাপ কোনও কিছুই নেই। খুব কমিটেড রাজনৈতিক কর্মী ছাড়া ভোটের কথা কেউ সরাসরি বলছেইনা। গৌরবের জেঠতুতো দাদা প্রদীপ বেজ জানালেন, ‘দেখুন, ভোট তো হবেই। সবাই ভোট দেবেও হয়ত কিন্তু এখন আর ওসব নিয়ে ভাবতে চাইছিনা আমরা। ৮ তারিখ সন্ধ্যা অবধি সবাই তো ভোট নিয়েই ছিল সবাই। কলকাতায় আগুন লেগেছে এটুকু জেনেছিলাম। কিন্তু রাত্রি ১১টার পর থেকে সব হিসাব বদলে যাচ্ছিল। প্রথম দিকে জেনেছিলাম দমকলের কয়েকজন কর্মী মারাত্মক জখম। কিন্তু রাত্রি ১টা নাগাদ সমস্তটা পরিষ্কার হয়ে যায়। দমকলের ৪ কর্মী মারা গেছে যার মধ্যে আমাদের গৌরব রয়েছে। সেই রাতেই গোটা পঁচেট খবরটা জেনে যায়।”
গৌরবের আরেক জেঠতুতো ভাই স্বপন বেজ জানালেন, ‘পঁচেট স্কুলে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ার পর চন্দনপুর আনন্দ ইনস্টিটিউটে উচ্চমাধ্যমিক। কিছুদিন এগরা কলেজে পড়ার পর কলকাতায় বাবার কাছে চলে যায় গৌরব আর তার ভাই সৌরভ এবং মা সবিতা। খুবই গরিব অবস্থা থেকে লড়াই করে সংসারকে টেনে তুলেছিলেন গৌরবের বাবা গুরুপদ।” কলকাতায় লোকের বাড়িতে কাজ করা, ফাই ফরমাস খাটা, দিনমজুরি কী করেননি?
শেষমেশ এক অদ্ভুদ পেশা তাঁকে কিছুটা আলো দেখালো যে পেশা তাঁর নিজের আবিষ্কার। যে সমস্ত নামী আইনজীবী, চিকিৎসক, অধ্যাপক ইত্যাদি প্রয়াত হন তাঁদের বাড়ি থেকে পুরানো বই সংগ্ৰহ করে তা বাঁধিয়ে বিক্রি করা। ক্রমে ক্রমে দুষ্প্রাপ্য সব বইয়ের খোঁজে গুরুপদর দ্বারস্থ হন নামী দামী ব্যক্তিত্ব। এই পেশায় ভর করেই ঢাকুরিয়ার কাছে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছিলেন গুরুপদ। স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে গেলেন সেখানে।
স্বপন জানালেন, ‘এখানকার বাড়ি ঘর, ১০কাটা চাষের জমি আমরাই দেখভাল করতাম। গৌরব প্রায় আসত। খুব আড্ডা মারত আমাদের সাথে, বৌদিদের সাথে, বন্ধুদের সাথে। এই কয়েকদিন আগেও এসেছিল। এসে ওর মামাবাড়ি জেনকাপুর গিয়েছিল। ছোট থেকেই পরের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার অভ্যাস ছিল ওর।”
স্থায়ী চাকরি ছিলনা গৌরবের। অস্থায়ী কর্মী ছিলেন দমকল বিভাগের। এর আগে রেলপুলিশের সিভিক হিসাবে কাজ করেছেন। ছেলে যাহোক কিছু একটা করছে এই আশায় হয়ত সুখের আশায় ছিলেন কিন্তু সে সুখ আর এলনা। পঁচেটের অরক্ষিত ঘরের মতই ঝুরঝুরে হয়ে সে স্বপ্ন ঝরে পড়ল সোমবার, ৮ই মার্চ। এরপর আর ভোট নিয়ে কার মাথা ব্যাথা হয়?