জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৮৯ চিন্ময় দাশ
বিষ্ণু মন্দির, রামচন্দ্রপুর (ময়না,মেদিনীপুর) পূর্ব তীরে পাঁশকুড়া, পশ্চিমে ময়না। দুই থানার বিভাজক রেখা হিসাবে প্রবহমান কংসাবতী নদী। জনৈক কুচল ঘোড়াই সবং এলাকা থেকে এসে, সেই নদীর লাগোয়া, ময়নার রামচন্দ্রপুর গ্রামে, বসবাস করতেন। কংসাবতির জলপথের সুবাদে, একদিকে ওডিশা অন্যদিকে জঙ্গল মহল থেকে কাঠের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা করতেন। কাঠের ব্যবসা থেকেই প্রভূত সম্পদের মালিক হয়ে উঠেছিলেন এই উদ্যমী পুরুষটি। বিশাল এক অট্টালিকা গড়েছিলেন নদীর একেবারে কোল ঘেঁষে। যেমন তেমন করে নয়। গুনে গুনে পঞ্চাশটি বাসোপযোগী কক্ষ ছিল তিন-মহলা বাড়িটিতে। প্রশস্ত দরবার হল, করিন্থিয়াম রীতির থাম, দরুণ-রীতির খিলান, টানা অলিন্দ, কিংবা যে কোনও আক্রমণ মোকাবিলায় অদৃশ্য অবস্থায় ভিতর থেকে বন্দুক চালাবার ব্যবস্থা, আপৎকালে আত্মরক্ষার জন্য গুপ্তপথ– কী ছিল না তাতে?
সম্পূর্ণ অট্টালিকা জুড়ে কাচের মত মসৃণ ঝকঝকে পলেস্তারা। দেওয়ালে দেওয়ালে দেবদেবীর মূর্তি– পঙ্খের প্রলেপ দিয়ে মোড়া সেগুলি। প্রতিটি দেওয়াল জ্যামিতিক আর রঙিন ফুলকারি নকশায় রঞ্জিত। তমলুক, মহিষাদল, ময়না; কিংবা লালগড়, চিল্কিগড় বা ঝাড়গ্রাম– সেকালের কোনও রাজবাড়ি এমন অলংকৃত করে নির্মিত হয়নি। এই মনোরম অট্টালিকাটি সেকালে প্রবাদে পরিণত হয়েছিল– “ময়না রাজার ধান। / কাশীজোড়ার মান। / দে নন্দীর টাকা। / কুচল ঘোড়াইর পাকা।”
কংসাবতীর করাল গ্রাসে সেই অট্টালিকার সিংহভাগ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বিশ বছর আগে পর্যন্তও এক শরিক বাস করেছেন সেই জীর্ণ প্রাসাদে। তারপর থেকে সেটি পরিত্যক্ত, ক্ষুধিত পাষাণের মত সেই খন্ডহর, এখন কেবল পর্যটকদের অপার বিস্ময়ের উপাদান হয়ে, কোনও মতে টিকে আছে।কুচল ঘোড়াই-র জ্যেষ্ঠ পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ। পাঁচ-পাঁচটি মন্দির গড়েছিলেন তিনি– ধর্মমন্দির, কালীমন্দির, শীতলামন্দির, শিবমন্দির এবং একটি বিষ্ণুমন্দির। প্রথম তিনটি মন্দির নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। শিবের মন্দিরটি আছে এখনও। সেবাপূজা প্রচলিত আছে সেখানে।
পৌনে দু’শ বছর আগে নির্মিত হয়েছিল মন্দিরগুলি। মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের প্রভাবে, সেসময় বাংলা জুড়ে ঘরে ঘরে বিষ্ণুর আরাধনা প্রচলিত হয়েছে। সারা জেলায় কোন রাজবাড়ি বা জমিদারবাড়ি ছিল না, যেখানে নতুন করে বিষ্ণু মন্দির গড়ে তোলা হয়নি। লক্ষীনারায়ণও সেই রীতির অনুসারী হয়ে, বিশাল আকারের একটি বিষ্ণু মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।
কিন্তু কেন যে নিয়তি সদয় ছিলেন না, কেউ জানে না। কেবল আকারে বিশাল নয়, অসংখ্য টেরাকোটা ফলক আর উন্নত পঙ্খের কাজে অলংকৃত মন্দির এটি। কিন্তু মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হলেও, কোনদিন দেবতার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়নি এখানে। আজও শূন্য দেবালয়টি দাঁড়িয়ে আছে নিয়তির করুণা বঞ্চিত হয়ে।এমন অনিন্দ-সুন্দর একটি দেবালয়ে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হল না কেন? নানান অভিমত জন্ম নিয়েছে বিগত পৌনে দু’শ বছরের দীর্ঘ সময়কালে। ১. কেউ বলেন, শরিকী বিবাদের কারণে, ঐকমত্য না হওয়ায়, বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হতে পারেনি। ২. পুরাবিদ প্রণব রায় তাঁর গ্রন্থে বলেছেন– “জানা যায়, মন্দির নির্মিত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মীনারায়ণ ঘোড়াই এক জটিল মামলায় জড়িত হন এবং তার ফলে এখানে কোনো বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়নি।” ৩. কেউ বা, রানি রাসমণি দেবীর উদাহরণ দিয়ে, বলেন– সেবাইতবংশ অব্রাহ্মণ হওয়ার কারণে, ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় বিগ্রহ প্রতিষ্ঠায় সম্মতি দেননি। ৪. তবে অধিকাংশের অভিমত হল– মন্দির নির্মাণের পর, বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে, মন্দিরের মাথায় নাকি কোন শকুনি বসে পড়েছিল। এই অশুভ ইঙ্গিতের কারণে, মন্দিরে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হয়নি।
শেষের এই অভিমতটিকেই যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয় আমাদেরও।
ইটের তৈরী দক্ষিণমুখী মন্দিরটি নব-রত্ন রীতিতে নির্মিত। ভিত্তিবেদীটি ছিল বড় বড় চতুস্কোণ খোপকাটা, বেশ উঁচু– যার সিংহভাগ মাটিতে চাপা পড়ে আছে। বেদীর উপর প্রশস্ত প্রদক্ষিণ-পথ। মন্দিরের কাঠামো বর্গাকার– দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সাড়ে ২৪ ফুট হিসাবে। মন্দিরের উচ্চতা নিয়ে মতপার্থক্য দেখা যায়। পুরাবিদ তারাপদ সাঁতরা বলেছেন ৫০ ফুট। প্রণব রায়ের অভিমত আনুমানিক ৫৫ ফুট। মাপজোক করে, সেবায়েত পরিবার জানিয়েছেন– ভিত্তিবেদী সহ মন্দিরের উচ্চতা ৬০ ফুট। সমগ্র তমলুক মহকুমায় অন্যতম উঁচু মন্দির এটি।
দক্ষিণ এবং পূর্ব– দুদিক জুড়ে অলিন্দ। প্রথম তলের দুটি অলিন্দে ইমারতি থাম এবং দরুন-রীতির খিলানে ৩টি করে দ্বারপথ। দ্বিতলের দ্বারপথগুলি ৮টি করে গোলাকার গুচ্ছ থাম এবং খিলান রীতির। উপর-নীচে চারটি অলিন্দ– সিলিং হয়েছে টানা-খিলান রীতিতে। প্রথম ও দ্বিতীয় তলের গর্ভগৃহের সিলিং হয়েছে পরপর বিপরীত দিকে খিলান নির্মাণ করে, তার মাথায় গম্বুজ স্থাপনের সাহায্যে। ন’টি রত্নের সিলিং গম্বুজের সাহায্যে রচিত।
মন্দিরের ছাউনি চালা-রীতির। তার উপর উঁচু বেদিতে স্থাপিত রত্নগুলি শিখর-দেউল রীতিতে নির্মিত হয়েছে। প্রত্যেকটিতে কলিঙ্গ প্ৰভাবে রথ-বিন্যাস করা। কেন্দ্রীয় রত্নে সপ্ত-রথ এবং অবশিষ্ট আটটি রত্নে পঞ্চ-রথ বিন্যাস। রত্নগুলির গণ্ডী অংশে সরলরৈখিক পীঢ় বিভাজন করা হয়েছে। রত্নগুলির লম্বাটে গড়ন এই মন্দিরের বিশেষ বৈশিষ্ট। তাতে রথ-বিন্যাস এবং পীঢ় বিভাজন মনোরম করে তুলেছে মন্দিরটিকে।
বিপুল উচ্চতা যেমন এই মন্দিরের বৈশিষ্ট্য, তেমনই মন্দিরটির গরিমা তার অলংকরণের সুবাদে। দক্ষিণ এবং পূর্ব দু’দিক জুড়ে, অজস্র টেরাকোটা ফলকে সাজানো হয়েছে মন্দিরসৌধটিকে। ফলকগুলি স্থাপিত হয়েছে– ছ’টি দ্বারপথের মাথায় বড় প্রস্থগুলিতে, কার্নিশগুলির নিচ বরাবর দুটি করে সমন্তরাল সারিতে এবং কোনাচ অংশের গায়ে খাড়া সারিগুলিতে। জ্যামিতিক এবং ফুলকারী নকশা ছাড়া, বাকি ফলকের সিংহভাগ রামায়ণ, কৃষ্ণ-লীলা, পুরাণ-কাহিনী এবং মঙ্গল কাব্য নির্ভর। রামায়ণ থেকে– স্বর্ণ-মৃগরূপী মারিচ বধ, সীতাহরণ, জটায়ু কর্তৃক রাবণের রথ আক্রমণ, রাম-রাবণের যুদ্ধ ইত্যাদি। কৃষ্ণ-লীলা থেকে– পুতনা-বধ, ননী-চুরি, গোষ্ঠ-লীলা, কালীয় দমন, বস্ত্রহরণ, কৃষ্ণের দ্বারকা গমণ ও গোপিনীদের শোক ইত্যাদি। পুরাণ-কথা থেকে– ঢেঁকিবাহন নারদ, চতুর্ভুজ নারায়ণ, শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান বিষ্ণুর দশাবতার, দশ-ভুজা মহিষমর্দিনী ও অন্যান্য দেবদেবীগণ ইত্যাদি। মঙ্গলকাব্য থেকে– ধনপতি এবং শ্রীমন্তের সিংহল গমণ, কমলে-কামিনী ইত্যাদি ফলক। এছাড়াও দ্বারপাল, বাদক-বাদিকা, সন্ন্যাসী পুরুষ ইত্যাদি বহু ফলকই রচিত হয়েছে মন্দিরের দেওয়ালে।
বিশেষ উল্লেখযোগ্য ফলক হল– ২০টি ফলকে রথ-বিন্যাস এবং পীঢ়-বিভাজন সহ ২০টি প্রতিকৃতি দেউল। প্রতিটির অভ্যন্তরে শিবলিঙ্গ দৃশ্যমান। পূর্বদিকের দেওয়ালে কার্নিশের নিচের সারিতে এটি রচিত হয়েছে। এইসব ছাড়াও, অজস্র পূর্ণাবয়ব মূর্তি স্থাপিত আছে দু’দিকের দেওয়ালের ছোট ছোট খোপে।একদিন সমগ্র মেদিনীপুর জেলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মন্দির হয়ে গড়ে উঠেছিল এই মন্দির। আজ তার ভারী জীর্ণ দশা। সারা অঙ্গ জুড়ে জরাগ্রস্ত এই সৌধ। প্রথম পর্বে দেবতার বিগ্রহ না থাকা, পরে জমিদারি উচ্ছেদ হয়ে সেবাইত পরিবারের অর্থসঙ্গতি নষ্ট হয়ে যাওয়া– মন্দিরের দুর্দশার মূল কারণ। এর পর ধীরে ধীরে অনাদর, অবহেলা, অসঙ্গতিতে ক্ষয়রোগ বাসা বেঁধেছে মন্দিরে। একটু একটু করে অবলুপ্তির পথে চলেছে মন্দিরটি।
মন্দিরটি সংস্কার এবং সংরক্ষণের জন্য আবেদনপত্র, সবরকম নথি, ফটোগ্রাফ ইত্যাদি সহ দীর্ঘকাল যাবৎ ভারতের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের কলকাতা সার্কেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও, তাঁদের টনক নড়ানো যায়নি।
আমাদের অভিমত, দেবালয়টিকে সাফ-সুতরো করে, নতুন করে একটি শালগ্রাম প্রতিষ্ঠা এবং নিত্যপূজার বন্দোবস্ত করলেও, ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো যায় এই অমূল্য সম্পদটিকে। দেশে-বিদেশে কর্মরত উচ্চশিক্ষিত, উঁচু অঙ্কের অর্থ-উপার্জনশীল বহু সদস্য আছেন ঘোড়াইবংশে। সেবাইত পরিবারগুলি সামান্য উদ্যোগী হলেও তো মন্দির রক্ষার অতি জরুরী কাজটি সম্পন্ন হতে পারে।
এর পাশাপাশি, অবিলম্বে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংরক্ষণ কাজে দক্ষ সংস্থা, পুরাপ্রেমী মানুষজন প্রমুখদের এগিয়ে এসে সৌধটির সংস্কার এবং সুরক্ষার কাজে হাত লাগাতে হবে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে এলাকার মানুষজনকেও। সকলের মিলিত চেষ্টায় বাঁচিয়ে তুলতে হবে মন্দিরটিকে। নইলে জেলার এই ঐতিহ্য সম্পদটি ধ্বংস হয়ে যাবে সকলের চোখের সামনে। তা যদি হতে দিই, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
সাক্ষাৎকার : শ্রী দীপক কুমার ঘোড়াই , শ্রীমতি সুমিতা ঘোড়াই– রামচন্দ্রপুর। শ্রী নির্মল ঘোড়াই, শ্রীমতি শিপ্রা ঘোড়াই– শরৎপল্লী, মেদিনীপুর শহর।
সমীক্ষা-সহযোগী : শ্রী পার্থ দে– তমলুক।
পথ-নির্দেশ : দ.পূ. রেলপথের পাঁশকুড়া স্টেশন থেকে প্রতাপুর হয়ে, রামচন্দ্রপুর স্কুলঘাট (১০ কিমি) / স্টেশন থেকে পুরুষোত্তমপুর হয়ে স্কুলঘাট (৬-৭ কিমি)। স্কুলঘটে নদী (সাঁকো আছে) পার হলেই রামচন্দ্রপুর গ্রাম। এছাড়া, তমলুক শহর (৩০ কিমি), শ্রীরামপুর কিংবা ময়না (১৩ কিমি) থেকে সরাসরি ট্রেকার চলাচল করে মন্দির পর্যন্ত।