রাহুল পাল: মেয়ে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। পাকা কথা অর্থাৎ বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার কথা ছিল সোমবার। মেয়ের বাড়ির লোকজন আসবে বাড়িতে। থাকবে গ্রামের পাঁচজন। সেই জন্য হাট থেকে বন্ধুর সাথে শাক সবজি কিনে ফিরছিলেন ২৭ বছরের যুবক। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল রবিবার সন্ধ্যায়। মোরাম বোঝাই ডাম্পারের ধাক্কায় বন্ধুর সাথেই চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেলেন দুজনেই। মর্মান্তিক এই ঘটনাকে ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়গপুর গ্রামীন থানার অন্তর্গত হরিয়াতাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের মাকড়বিন্দা এলাকা। উত্তেজিত গ্রামবাসীরা আগুন লাগিয়ে দেন ডাম্পারে। বিক্ষোভরত জনতাকে শান্ত করতে কলাইকুন্ডা ফাঁড়ি থেকে পুলিশ কর্মীরা এলে তাঁদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে জনতা।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে নিহত দুই যুবকের নাম ভবসিন্ধু মাহাত (২৭) ও লক্ষীকান্ত সহিস (২৮)। ভবসিন্ধুর বাড়ি হরিয়াতাড়া এবং লক্ষ্মীকান্তর বাড়ি গেড়িয়াশুলি গ্রামে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ভবসিন্ধুর বিয়ের দিনক্ষণ পাকা হওয়ার কথা ছিল। সেই জন্য ৫ কিলোমিটার দুরের নেকড়াশুলির হাটে বাজার করে ফিরছিল তারা। তখনও দিনের আলো ছিল যথেষ্টই। রাস্তাও যথেষ্ট ফাঁকা ছিল। বাইকে করে দুজন যাচ্ছিলেন বাড়ির দিকে। বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার আগে মাকড়বিন্দার কাছাকাছি স্থানীয় মোরাম খাদান থেকে একটি মোরাম বোঝাই ডাম্পার তাদের পেছনে পেছনে আসছিল।
এই সময় বাইক আরোহীদের সামনে কোনও কিছু চলে আসায় বাইকের গতি কমিয়ে দেয় তারা আর তখুনি ডাম্পারটি বাইক সমেত তাঁদের ওপর দিয়ে চলে যায়। বাইক সমেতই পিষে যান দুজনেই। এরপর ডাম্পারটি রাস্তার পাশে রেখে দিয়ে চম্পট দেয় চালক। কিছুক্ষনের মধ্যেই পথ চলতি মানুষজন ঘটনাটি দেখতে পেয়েই খবর দেন আশেপাশের গ্রামে। লোকজন ছুটে আসে। ছুটে আসে গেড়িয়াশুলি হরিয়াতাড়ার মানুষও। প্রথমে তাঁরা বাইক দেখে চিনতে পারেন যে যুবকরা তাঁদের এলাকারই। পরে দুজনকেই চিনতে পারা যায়।
চোখের সামনে পাশাপাশি গ্রামের দুই যুবককে পিষে যেতে দেখে কান্নার রোল পড়ে যায়। পরে সেই কান্না পরিণত হয় ক্রোধে। ক্রুদ্ধ মানুষজন পোড়াপাড়া, কলাইকুন্ডা অবধি ওই সড়ক অবরোধ করেন পরে আগুন লাগিয়ে দেন ডাম্পারে। এমনিতেই মোরাম আর বোল্ডার খাদানের জ্বালায় এমনিতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত গ্রামের পর গ্রাম মানুষের। রাস্তাঘাটের বারোটা বেজে যাচ্ছে প্রতিদিনই। দুর্ঘটনা যেন নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এলাকার মানুষের। তার ওপর দু’দুটো জলজ্যান্ত যুবকের এই পরিণতিতে যেন আগুনে ঘি পড়ে। খবর পেয়ে খড়গপুর গ্রামীণ থানার অন্তর্গত কলাইকুন্ডা ফাঁড়ির পুলিশ কর্মীরা ছুটে এলে তাঁদেরও ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন মানুষ।
গ্রামবাসীদের দাবি মোরাম আর বোল্ডার খাদানের জন্য বেহাল রাস্তায় নিত্যদিনের দুর্ঘটনা লেগেই রয়েছে। বারংবার পুলিশ প্রশাসনকে জানিয়েও লাভ হয়নি। এক আধবার তারা আসেন, দেখেন চলে যান। এদের দাপটে দু’একবছর আগে তৈরি হওয়া রাস্তার বেহাল দশা। যেমন ধাদকি-কেলেঘাই, ধাদকি-দেওয়ানমাড়ো, বাঁশপতরি-কলাইকুন্ডা রাস্তায় যাতায়ত করাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। কয়েকদিন আগেই শাকপাড়া এলাকায় একটি খাদানকে বেআইনি চিহ্নিত করা হয়েছে কিন্ত তারপরেও কয়েকটি বেআইনি খাদান চলছে। আর সমস্ত গাড়িতেই ওভারলোড করে মাল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
পুলিশ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনতাকে শান্ত করে রাস্তা অবরোধ মুক্ত করে দেহ দুটি তুলে নিয়ে যায়। পরে WB-33B/7410 নম্বরের ওই ডাম্পারের চালক শুভলক খানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ৪২ বছরের ওই চালকের বাড়ি সবং থানার লুটুনিয়া গ্রামে বলে জানা গেছে। খড়গপুর মহকুমা হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর দেহ দুটি সোমবার দুপুর ২টা নাগাদ গ্রামেই সৎকার করা হয়েছে।