পলাশ খাঁ :- বাঙালী মানেই চপ মুড়ি এই খ্যাতি সুবিদিত। তার উপর মুড়ি খাওয়ায় বাঁকুড়াবাসীর সুনাম আরো বেশী । আর সেই মুড়িকে নিয়েই হয় একটি আস্ত মেলা! কাতারে কাতারে মানুষ হাজির শুধু মুড়ি খেতেই। যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মুসকিল।
বাঁকুড়াবাসীর যে মুড়ির প্রতি কতোটা প্রীতি রয়েছে তা টের পেতে আপনাকে হাজির হতে হবে বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়ায় দ্বারকেশ্বর নদের চরে।
প্রতিবছর ৪ ঠা মাঘ শীতের আমেজ গায়ে নিয়ে হাজার হাজার মানুষ জোড়ো হয় এই মুড়ি মেলায়। শুধুমাত্র সকালের মিঠে রোদে নদের বালির চরে মুড়ি খেতেই হাজির হন।
মকর সংক্রান্তির পিঠে পরবের রেশ কাটতে না কাটতেই রোজকার খাদ্য তালিকা, স্বাস্থ্য বিধান ভুলে চপ, খুগনি, টম্যাটো, শশা, গাজর, মটরশুঁটি, কাঁচালঙ্কা, সরিষার তেল মাখিয়ে নদের চরে খবরের কাগজ পেতে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন পরিবার পরিজনকে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে মুড়ি খাওয়ায় আয়োজন দেখলেই টের পাওয়া যায় এই মুড়ি মেলার মাহাত্ম্য । সঙ্গে সাধ্যানুযায়ী পেঁয়াজ, চানাচুর, নারকেলের মিশ্রণ আর লাল লঙ্কার ঝাল চাটনি। দ্বারকেশ্বর নদের পাড়ে বসে হাজার হাজার মানুষের প্রাতরাশ করার এই হুজুগ-ই মেলার প্রধান অঙ্গ।
অপরদিকে মুড়ি মেলার টানে দ্বারকেশ্বর নদের পাড় বরাবর বালুচরে অসংখ্য ছোট বড়ো চপ, ঘুগনির দোকান৷ দোকানগুলির কড়াইয়ে টগবগিয়ে ফুটছে আলু-মটরের ঘুগনি, গরম তেলে ভাজা, চপ, সিঙ্গাড়া। উনুনে বসানো চায়ের কেতলির মুখ থেকে গল গল করে বেরোচ্ছে ধোঁয়া। তেলেভাজার গন্ধে ম ম করে দারকেশ্বর নদের চরে চলা গোটা মেলা চত্বর।
প্রতি বছরই এই মেলাতে আসা কলেজ পড়ুয়া অষ্টাদশী তরুণী অরুণিমা রায় বলেন, মাঘের এই শীতল সকালে নদের চরের মৃদুমন্দ ঠান্ডা বাতাস গায়ে মেখে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে একসঙ্গে বসে হরেকরকমের উপকরণ মেখে মুড়ি খাওয়ার মজাই আলাদা।
বাঁকুড়া শহর সংলগ্ন কেঞ্জাকুঁড়া গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে দ্বারকেশ্বর নদ। সেই নদের পাড়েই রয়েছে সঞ্জীবনী আশ্রম। জানা যায় এই সঞ্জীবনী আশ্রমে বহু বছর আগে থেকেই মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে হরিনাম সংকীর্তন হয় । এই হরিনাম চলে সপ্তাহ জুড়ে। স্থানীয়রা বাসিন্দার জানান, সেই সময় সময় ওই এলাকাই ছিল ঘন জঙ্গলে । ফলে জঙ্গলে হিংস্র জন্তুদের অবাধ বিচরণ ছিল। এমনিতেই এই এলাকায় কেউ বিশেষ আসতো না৷ কিন্তু হরিনামের টানে বহু দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসতেন হরিনাম শুনতে এই সঞ্জীবনী আশ্রমে। ভক্তরা সকলেই আসতেন দিনের বেলায় ফিরেও যেতেন দিনের বেলায়। রাত্রী হয়ে গেলে কেউ আর ফিরতো না বাড়ি। কারণ হিংস্র জীবজন্তুর আক্রমণের ভয় ছিল পথে। অনেকেই আবার সারারাত থাকার প্রস্তুতি নিয়েই আসতেন। প্রায় প্রত্যেক ভক্তই নিজেদের খাবার জন্য সঙ্গে মুড়ি নিয়ে আসতেন৷ মুড়ি এতোটাই আনতেন যে নিজের খাওয়া হওয়ার পরেও আরো দু একজনের খাওয়া যেতো। যারা ফিরতে পারতো না বা যারা রাত্রে থাকাতো তারা সকলেই সারারাত জেগে নামগান শুনে পরের দিন সকালে দ্বারকেশ্বর নদের জলে নিজেদের সঙ্গে থাকা মুড়ি ভিজিয়ে খেয়ে বাড়ি ফিরতেন। ভক্তদের সেই মুড়ি খাওয়ার রেওয়াজ এখন মেলাতে পরিণত হয়েছে । হিংস্র জন্তুর ভয় এখন নেই। নেই তখনকার মতো ঘন জঙ্গল। আশ্রমে বসেছে বৈদ্যুতিক আলো। তাই ভক্তদের রাত্রীতে থাকার বালাই নেই। কিন্তু রয়ে গেছে সেই হুজুগ। এখন সকলেই বাড়ি থেকে সঙ্গে করে পাহাড় প্রমাণ মুড়ি নিয়ে আসে। পিকনিকের মেজাজে বছরের এই দিনটি চলে দেদার মুড়ি খাওয়া। জিমে উঠে মুড়ি মেলা। তার উপর এই মুড়ি মেলাকে ঘিরে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দিনটিকে উৎসবের রূপ দেওয়া হয়েছে। হরেকরকম পসরার দোকানে রমরমিয়ে চলে বিক্রিবাটা।
মুড়ি মেলার উদ্যোক্তারা জানান, ” সঞ্জীবনী আশ্রম কে ঘিরে দ্বারকেশ্বর নদের পাড়ের এই পুরনো স্মৃতি উসকে দিতেই এই মুড়ি মেলার আয়োজন।