Homeএখন খবরতেমাথানির শ্মশানে বড়দিনের কান্না! ভেঙে দেওয়া কাঠামো লুঠ হচ্ছে, পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি কোথায়...

তেমাথানির শ্মশানে বড়দিনের কান্না! ভেঙে দেওয়া কাঠামো লুঠ হচ্ছে, পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি কোথায় গেল? প্রশ্ন তৃণমূলেই

নিজস্ব সংবাদদাতা: বৃহস্পতিবার বিকালে কার্যত শ্মশান হয়ে পড়ে রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবং থানার তেমাথানি বাজার। বাজার বলছি বটে কিন্তু বাজারের কোনও অবশিষ্ট নেই। বৌদির চা বিস্কুটের দোকান, সার দিয়ে থাকা সবজি দোকান, ভুষিমাল দোকান, মনোহরি দোকান, হার্ডওয়্যার, খাবার দোকান, সমস্ত কিছুই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় দোকানদাররা অভিযোগ করেছেন, জিনিসপত্র সরানোর সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি। অন্ততঃ ৩০০দোকান ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।

শুক্রবার সকাল। ২৫শে ডিসেম্বর, বড়দিন। সবংয়ের জায়গায় জায়গায় পিকনিকের আমেজ। নদী, খালের পাড়ে পাড়ে ডিজে বাজিয়ে নাচানাচি, মুরগি কিংবা খাসির মাংস। শুধু কাঁদছে তেমাথানি। মাথা খুঁড়ছে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া ধ্বংসস্তূপে। যদি এক আধটু কিছু পাওয়া যায়। আগের দিনের বিভীষিকার ধকল কাটাতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। ভোর থেকে হামলে পড়েছে একদল মানুষ। অবাধে লুট হয়ে যাচ্ছে ইট, রড, গৃহস্থালির জিনিসপত্র। হতভম্ব, উচ্ছেদ হওয়া ব্যবসায়ীদের দেখার ক্ষমতা নেই। ধ্বংসস্তূপের তলায় চলে গেলে কোটি কোটি টাকার সম্পদ, ‘আমাদের জিনিসপত্র সরানোর সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।’ বললেন ব্যবসায়ীরা।

তেমাথানি থেকে পটাশপুর রাস্তা চওড়া হবে। তার জন্য কত মিটার জায়গার দরকার ছিল? হিসাব বলছে ১২মিটার। ৭মিটার পিচ আর দুপাশের মোরাম মাটি সহ আরও ৫মিটার। সবং থানা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক বিশ্বব্রত ভট্টাচার্য বলছেন, ‘আমরা ১৬মিটার অবধি দু’পাশে রাস্তা ছেড়ে দিয়েছিলাম তারপরের জায়গাটা ভাঙার কোনও দরকার ছিল কী? আর যদি ভাঙাই হল, আমাদের তিনটে দিন সময় দেওয়া যেতনা? বুলডোজার নামিয়ে এমন গুঁড়িয়ে দেওয়ার দরকার ছিল? এমন শ্মশান বানিয়ে উন্নয়ন করা খুব জরুরি ছিল?”
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পূর্তদপ্তরের এক অধিকারিক জানিয়েছেন, ‘পুরো জায়গাটাই উচ্ছেদ করতে হবে এমনই আদেশ ছিল আদালতের। আর দীর্ঘদিন ধরে সেই আদেশ পালন না করতে পারায় আদালত অবমাননার দায়ে বারংবার পূর্তদপ্তরের আধিকারিকদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। গত কয়েকবছর ধরে সময় দেওয়া হয়েছিল। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাস্তা সম্প্রসারনের বিষয়টি। দুটো মিলিয়েই এই উচ্ছেদ অভিযান। তাই অভিঘাতটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে।”

সবং পঞ্চায়েত সমিতির তৃনমূল সদস্য তথা ব্যবসায়ী তাপস পাত্র জানিয়েছেন, ‘যে জায়গা থেকে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে তার পুরোটাই কিন্তু জবর দখল নয়। আটের দশকে, একবার রাস্তা সম্প্রসারনের সময় বাম আমলে তৎকালীন মহকুমা শাসক, বাম পঞ্চায়েত সমিতি, জেলাপরিষদ ইত্যাদির সমন্বিত উদ্যোগে মহকুমা শাসকের তহবিল থেকে প্রায় ৭৮ লক্ষ টাকা খরচ করে কিছু ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়। উচ্ছেদ সেই জায়গাতেও করা হয়েছে। এক সরকার পুনর্বাসন দিলে আরেক জায়গায় উচ্ছেদ করে কী করে, তাও পুনর্বাসন ছাড়াই?”
জানা গেছে তেমাথানিতে একটি দোকানের ভাড়া নেওয়া দেওয়ার অভিযোগে কাঁথির বাসিন্দা এক দোকানদারকে ভাড়া থেকে উচ্ছেদ করার পর সেই দোকানদার হাইকোর্টে একটি মামলা করে সমস্ত দোকানদারকেই পূর্তদপ্তরের জায়গা থেকে উচ্ছেদ করতে হবে বলে। আদালত তারপক্ষে রায় দেয়। গত কয়েকবছর ধরে সেই রায় কার্যকরী করা যায়নি বলে আদালতে ভর্ৎসিত হচ্ছিলেন আধিকারিকরা। তাই এই উদ্যোগ।

বিশ্বব্রত ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, “আমরা আদালতের রায় অবমাননা করিনি। ওই রায়ের পর আমরা একটি আলোচনায় বসেছিলাম। যেখানে সাম্প্রতিক মহকুমা শাসক, সভাপতি, জেলাপরিষদের কর্মাধ্যক্ষ, জেলা শাসকের প্রতিনিধি, সাংসদ ইত্যাদি সবাই ছিলেন। সেখানে ঠিক হয়েছিল দুর্গামন্দির সংলগ্ন প্রায় ১০০ফুট লম্বা, ৫০ফুট চওড়া ফাঁকা জায়গায় একটি মার্কেট কমপ্লেক্স করা হবে যেখানে ১০০জন রায়ত ব্যবসায়ী দোকান পাবেন এর বাইরে আরও একশ জন ছোট ব্যবসায়ীকে আমরা জায়গা দেব যাতে অন্ততঃ ৯০ভাগ ব্যবসায়ী পুনর্বাসন পেয়ে যাবেন। তৎকালীন পরিবহন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী কথা দিয়েছিলেন তাঁকে ডিপিআর (বিস্তারিত পরিকল্পনা রিপোর্ট) দিলে তিনি সেই মার্কেট কমপ্লেক্স বানানোর উদ্যোগ নেবেন। কিন্তু সেই ডিপিআর বানানোই হলনা! এই দায়িত্ব কী ব্যবসায়ীদের ছিল? কথা হয়েছিল সেই পুনর্বাসনের পরেই সরানো হবে ব্যবসায়ীদের। সেই সমস্ত কাগজ আমাদের কাছে রয়েছে। প্ৰয়োজনে আমরাও আদালতে যাব সেই কাগজ নিয়ে।”

পূর্তদপ্তরের সহকারী বাস্তুকার রামকৃষ্ণ ঘোষ জানিয়েছেন, ‘পূর্তদপ্তরের জায়গা রয়েছে অনেকটাই। আমরা প্রয়োজন অনুসারে তা ব্যবহার করি। এখন রাস্তা সম্প্রসারিত হবে তাই জায়গার দরকার। তার সাথে আদালতের নির্দেশ ছিল দপ্তরের পুরো জায়গাটা খালি করতে হবে।” তেমাথানি এলাকার এক স্থানীয় তৃনমূল নেতা বলেন,”২০১১সালের আগের কথা মনে আছে? যে কোনও জায়গাতেই উচ্ছেদ হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছুটে যেতেন। অপারেশন সানসাইন থেকে উড়ালপুলে হকার উচ্ছেদ সর্বত্রই তিনি। ক্ষমতায় আসার সময় তাঁর শ্লোগান ছিল আইনি বা বেআইনি দখলদারি পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ করা হবেনা। আর আজ দেখুন কী নির্মমভাবে উচ্ছেদ করা হচ্ছে! আগের সরকার তবুও একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য। এখানে তো সরকারই নেই। আমরা দু’দিন ধরে ছোটবড় নেতাদের কাছে দৌড়েছি কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। এরপর মানুষের কাছে মুখ দেখাবো কী করে?”

সবং তৃনমূলের ব্লক সভাপতি তথা প্রাক্তন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অমল পন্ডা জানিয়েছেন, ‘অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ওই এলাকায় সৌন্দর্যায়ন ও মিনি মার্কেটের ব্যবস্থা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা পুনর্বাসন পাবেন। আগের পরিকল্পনা বাতিল হলেও আমরা পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে ফের নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করছি। এক্ষেত্রে আদালতের রায় কার্যকরী করার বাধ্যবাধকতা ছিল। আমাদেরও দলীয় কার্যালয় সরাতে হয়েছে। এরমধ্যে কেউ ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা করছে।”

শুধু দোকান নয়, গোটা ১৫ পরিবার থাকতেন ওখানে। যাঁরা ঝুড়ি বানিয়ে সংসার চালাতেন। ৬০ বছর আগে বিহার থেকে আসা একটি পরিবার, সেলুন চালাতেন। কাল এঁদের মাথার ওপর দিয়ে কনকনে শীত গেছে। ভোরে উঠেই এক মহিলা একটি গোঁদল (শিশুকে দুধ খাওয়ানোর পাত্র ) খুঁজছেন। কিন্তু এত ইট কাঠ কংক্রিটে বুঝতেই পারছেননা তাঁদের বাড়িটা কোথায় ছিল? কেউ খুঁজছেন, আধারকার্ড, ভোটার কার্ড। আর ক’দিন পরেই যে ভোট!

RELATED ARTICLES

Most Popular