জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ২৩
চিন্ময় দাশ।
জগন্নাথ মন্দির, সুজাগঞ্জ, মেদিনীপুর শহর।
বহু প্রাচীন কালের নগরী মেদিনীপুর। কপিসা বা কংসাবতী নদীর উত্তর তীরে গড়ে উঠেছে এই নগরী। দক্ষিণ দিকে নদী অতিক্রম করে শহরে ঢোকার মুখেই আকাশে মাথা তুলে দাঁড়ানো ঋজু গড়নের জগন্নাথ মন্দির। দেখামাত্রই মনে হয়, এই শহরের প্রাণপুরুষ, শহরের অভিভাবক হলেন জগন্নাথ দেব।
তবে, এখন যে মন্দির আমরা দেখি, সেটি প্রকৃতপক্ষে জগন্নাথের দ্বিতীয় মন্দির। উনিশ শতকের একেবারে মাঝামাঝি সময়ে এটি গড়ে তোলা হয়েছিল।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
আদি মন্দিরটি ছিল বহুকাল আগের তৈরী। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মেদিনীপুরের প্রায় সমগ্র ভূভাগ ছিল কলিঙ্গ রাজাদের শাসনাধীন। সেসময়ই ওডিশার গঙ্গবংশীয় কোনও নৃপতি সেটি নির্মাণ করে থাকবেন। শহরের একেবারে দক্ষিণ সীমায়, ওডিশা ট্রাঙ্ক রোডের উপর, কংসাবতী নদীর কোলে অবস্থান ছিল মন্দিরের। শিখ ধর্মগুরু নানকদেবও পুরী যাত্রার কালে এই মন্দিরে এসেছিলেন। তাঁর পবিত্র স্মৃতিতে একটি ” নানক সঙ্গত ” গড়ে তোলা হয়েছিল এখানে। জেলা শহরের ” সঙ্গত বাজার ” আজও নানকদেবের স্মৃতি বহন করে চলেছে।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে দু-দুটি ভয়ানক বন্যা হয়েছিল কংসাবতী নদীতে। ১৮২৩ সালের বন্যার পর, ১৮৩৯-৪০ সালে পুনরায় বন্যা হয়। দুর্যোগে টানা ৭ দিন সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। সেই বন্যায় মন্দিরটি, খেয়াঘাট, যাত্রীদের চটি ইত্যাদি সম্পূর্ণ ভেসে যায়। কোনও কিছুরই চিহ্ন ছিল না।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
জগন্নাথের ভেসে যাওয়া বিগ্রহ উদ্ধার বা তাঁর জন্য নতুন মন্দির গড়ে তোলার কাহিনী সংগ্ৰহ করতে লোকশ্রুতি আর মন্দিরলিপির সাহায্য নিতে হবে আমাদের। যা জানা যায়, তা হল– সেসময় শহরে নামকরা জমিদার ছিলেন জন্মেঞ্জয় মল্লিক। সপ্তাহভর দুর্যোগ কেটে যাওয়ার পর, অষ্টম দিনের বিকেল বেলা। সপার্ষদ জমিদার নদীর তীরে এসেছেন। ভ্রমণও বলা যায়, আবার ক্ষয়ক্ষতি নিজের চোখে দেখাও। হঠাৎই নারীকন্ঠের জগন্নাথ বন্দনার সুর কানে লাগল জমিদারের। দেখা গেল, একটি কুঁড়েঘরে এক বৃদ্ধা তিনটি বিগ্রহের সামনে বসে গান গাইছেন ভক্তিভরে।
জলে ধোয়া তিনটি দারুবিগ্রহ– জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রা দেবী। বন্যায় ভেসে যাওয়া বিগ্রহগুলি নদীর কুল থেকে কুড়িয়ে এনেছিলেন বৃদ্ধাটি। সেদিন রাতেই মন্দির নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য দেবতার স্বপ্নাদেশ পান জন্মেঞ্জয়। জন্মেঞ্জয় ছিলেন তাম্বুলী সম্প্রদায়ভুক্ত। তিনি উদ্যোগী হয়ে শহরের তাম্বুলী জাতির ব্যবসায়ীদের সহায়তায় জগন্নাথদেবের বর্তমান মন্দিরটি গড়ে তোলা এবং নতুন করে সেবাপূজার প্রচলন করেছিলেন। সেকারনে জন্মেঞ্জয়কেই বর্তমান মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে গণ্য করা হয়।
যোগেশ চন্দ্র বসু প্রমুখ জেলার ইতিহাস রচয়িতা সকলেই তাঁকে এই স্বীকৃতি দিয়েছেন। ১৯২১ সালটি মেদিনীপুর জেলার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। সেবছরই যোগেশ চন্দ্রের ” মেদিনীপুরের ইতিহাস ” প্রকাশিত হয়। ১৯২১-য়েই ” BENGAL DISTRICT GAZETTEERS MIDNAPORE ” প্রকাশ করেন L. S. S. O’MALLEY সাহেব। সেখানেও মন্তব্য আছে– ” … and the temple of Jagannath, built 60 or 70 yers ago by the shopkeepers of bazar, are the only buildings with any pretentions of architectural beauty. ” । যাইহোক, ইং ১৮৫১ সাল বা বাংলা ১২৫৮ সনে বর্তমান জগন্নাথ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
ইটের তৈরী দক্ষিণদ্বারী মন্দির। কলিঙ্গশৈলীর শিখর দেউল রীতিতে নির্মিত। দৈর্ঘ্য প্রস্থ ২১ ফুট হিসাবে। উচ্চতা প্রায় ৭৩ মূল মন্দিরের সামনে একটি জগমোহন অংশ আছে। সেটি চার্-চালা রীতির। চালায় কলিঙ্গশৈলীর পীঢ়-ভাগ করা। ঘন সন্নিবদ্ধ ২৯টি থাকে সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। মূল মন্দিরে বাঢ় এবং গন্ডী জুড়ে নব-রথ বিভাজন করা।
মন্দিরের সামনে একটি উন্মুক্ত নাটমন্দির, গরুড়স্তম্ভ এবং দ্বিতল বিশিষ্ট নহবতখানা।
তেমন কোনো অলংকরণ নাই মন্দিরে। কয়েকটি টেরাকোটা ফলক– তামাক সেবনরত জমিদার, মা যশোদার দধিমন্থন, মিথুনমূর্তি দেখা যায়। সামান্য কিছু পঙ্খের নকশাও আছে জগমোহনের দেওয়ালে।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
যাওয়া-আসা — জেলা শহরের একেবারে দক্ষিণে এই মন্দির। কংসাবতীর ব্রিজ পার হয়ে শহরে ঢুকলে, জগন্নাথ মন্দির বাসস্টপ। পথের পাশেই মন্দির। শহরের বাসস্ট্যান্ড বা রেলস্টেশন থেকে সবরকম গাড়ি চলাচল আছে।
প্রচ্ছদ: রামকৃষ্ণ দাস