জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৭১
রাজরাজেশ্বর মন্দির, সাঁকোয়া (থানা খড়গপুর, মেদিনীপুর)
চিন্ময় দাশ
আজকের এই জার্নালের নায়ক একজন বহিরাগত। বহু দূর পথ পাড়ি দিয়ে মেদিনীপুর জেলায় এসে পৌঁছেছিলেন তিনি। প্রথমে তাঁর যাত্রাপথের ছবিটি এঁকে নেওয়া যাক।
যাত্রার সূচনা ঢাকা-বিক্রমপুর, যমুনার তীরে। গুহ রায় পদবীর একটি বনেদী বংশের বাস ছিল সেখানে। দামোদর গুহ রায়ের ২ পুত্র– বিশ্বম্ভর ও নীলাম্বর। ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়েছিলেন দুই সহোদর ভাই। যমুনার তীর থেকে রওণা হয়ে, বহু পথ পাড়ি দিয়ে এসে থেমেছিলেন গঙ্গার পশ্চিম তীরে, হাওড়ায়।
সেখানেও থিতু হতে পারলেন না, বালি-কোতরংগ-এর জমিদারের সাথে বিবাদ শুরু হোল। আবার অজানার পথে যাত্রা। দুটো ঘোড়ায় চেপে আগুয়ান হলেন দুই সহোদর। গড় মান্দারণ থেকে বাদশাহী সড়ক ধরে নাড়াজোল পরগণায় ঢুকলেন, কিন্তু থামলেন না। দক্ষিনমুখো হয়ে, ‘নন্দ কাপাসিয়ার জাঙ্গাল’ ধরে যেতে যেতে পৌঁছলেন খান্দার পরগণায়। সেখানে দুটি ভিন্ন পথে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন দুই সহোদর।
জ্যেষ্ঠ বিশ্বম্ভর পৌঁছলেন সাঁকোয়া (বর্তমানমেদিনীপুর জেলার খড়্গপুর থানা) এবং কনিষ্ঠ নীলাম্বর থামলেন নাড়মা (বর্তমানমেদিনীপুর জেলার নারায়ণগড় থানা) গ্রামে। ২টি গ্রামই খান্দার পরগণা আর নারায়ণগড়ের পাল রাজাদের জমিদারী এলাকা। জানা যায়, রাজারা দুই সহোদর ভাইকে দুটি পৃথক জমিদারী দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এখানে একটি গাণিতিক হিসাব কষে নেওয়া যেতে পারে। গুহরায় বংশ বলেন, তাঁরা সাঁকোয়া এসেছিলেন আমলি সন ১০১০ সাল বা ইং ১৬০৪ সালে। এদিকে, মন্দির সমীক্ষার সময়, গুহরায় বংশ থেকে আমরা যে বংশলতিকা পেয়েছি, সেটি ৯/১০ পুরুষের। আমাদের হিসাব, নারায়ণগড়ের জমিদার শ্যামবল্লভ শ্রীচন্দন পাল (১৬১৩ – ১৬৭৮)-এর শাসনকালেই দুই ভাই এই এলাকায় এসেছিলেন, এমনটাই হতে পারে।
নারায়ণগড় জমিদারি সম্পর্কে দু-চার কথা বলে নেওয়া যেতে পারে এখানে। বাংলা সন ৬৭১ বা ইং ১২৬৪ সালে গন্ধর্ব পাল এই বংশের পত্তন করেছিলেন। পুরীর রাজা রাজছত্র, উপবীত এবং জগন্নাথদেবের নাভীর ‘ চন্দন ‘ উপহার সহ গন্ধর্বকে একটি বড় মাপের জমিদারিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন থেকে এই বংশের পদবি হয়েছিল– শ্রীচন্দন পাল।
নারায়ণগড়ের ত্রয়োদশতম রাজা শ্যামবল্লভ শ্রীচন্দন পাল। ভারত সম্রাট জাহাঙ্গীরের ৩য় পুত্র খুররম পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে, ২ বছর বাংলা অধিকার করে রাখার পর, ১৬২৪ সালে, সম্রাটের বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে, যখন নারায়ণগড়ের উপর দিয়ে দাক্ষিণাত্যে পালিয়ে যাচ্ছেন, শ্যামবল্লভ এক রাত্রির মধ্যে খুররম ও তাঁর বাহিনীর জন্য যাত্রাপথ প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে শাহ জাহান নাম নিয়ে খুররম যখন ভারত সম্রাট হলেন, রাজা শ্যামবল্লভকে ‘মাঢ়-ই-সুলতান’ (পথের রাজা) উপাধি প্রদান করেছিলেন তিনি। সেসময় থেকে এই রাজবংশের পদবি হয়– শ্রীচন্দন পাল মাঢ়-ই-সুলতান।
সাঁকোয়া গ্রামে স্থায়ী হয়েছিলেন বিশ্বম্ভর। বহু প্রাচীন কালের ঐতিহ্যসম্পন্ন জনপদ এই সাঁকোয়া গ্রাম। সমীক্ষার সময় পূর্বপাড়ায় একটি প্রাচীন ঢিবি দেখেছি আমরা। তার অভ্যন্তরে কোন ইতিহাস লুকিয়ে আছে, কে জানে! সেই প্রাঙ্গণেই খাঁজকাটা বড় আকারের গোলাকার একটি মাকড়া পাথরখন্ড পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। একদিন যা বিশালাকার কোনও মন্দিরের মাথার আমলক হিসাবে বিরাজিত ছিল। আমাদের আলোচ্য রাজরাজেশ্বর মন্দিরের অঙ্গণেও একটি আয়তাকার পাথরখন্ড রাখা আছে। সেটির উপর ‘বা-রিলিফ রীতি’তে ধ্যানস্থ যোগীপুরুষ মূর্তি খোদিত। এইসকল এলাকা যে এককালে সমৃদ্ধ জনপদ হিসাবে গড়ে উঠেছিল, এগুলি তার পাথুরে প্রমাণ।
যাইহোক, জমিদারী প্রতিষ্ঠার সময়, নিজেদের অট্টালিকার সাথে বড় বড় বাঁধানো ঘাট সহ ঠাকুরপুকুর এবং কুলদেবতা রাজরাজেশ্বরজীউর জন্য বেশ বড় মাপের একটি মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন গুহরায়রা। ঘটা করে পূজার প্রচলন হয়েছিল। নিত্যদিন ৫০ সের চালের অন্নভোগের আয়োজন। জাঁকজমকের সাথে রথযাত্রা, ঘটা করে রাস উৎসবের প্রচলন করা হয়েছিল সাঁকোয়ায়। কিছুকাল পরে, একটি রাসমঞ্চও নির্মাণ করা হয়েছিল দেবতার উৎসবের জন্য।
বাংলা ১৩৪৯ সন বা ইং ১৯৪২ সালের প্রলয়ংকর ঘূর্ণিঝড় এবং পরের বছর ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’-এর অভিঘাতে রথযাত্রাটি রদ হয়ে গিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর, জমিদারী ব্যবস্থা উচ্ছেদ হয়ে গেলে, দেবসেবায় সংকটের সূচনা হয়। কালে কালে মন্দিরটি জীর্ণ হয়ে পড়লে, দেবতাকে ছোট একটি মন্দিরে (দেবতার স্নানমন্দির) স্থানান্তরিত করে নিতে হয়েছে। এখন যতটুকু টিকে আছে, সেটি মন্দির নয়, মন্দিরের কঙ্কাল মাত্র।
২০ ফুট দীর্ঘ, ৩০ ফুট প্রস্থ আর ১৬ ফুট উঁচু পরিমাপের বড়সড় আকারের পূর্বমুখী মন্দির এটি। তৈরী হয়েছে ইট-চুন-সুরকির উপাদানে। এখনও ফুট আড়াই উচ্চতা আছে পাদপীঠ অংশটির। মন্দিরকে বেস্টন করে প্রশস্ত একটি প্রদক্ষিণ-পথ আছে পাদপীঠের উপর। তার সামনের অংশটির বিস্তার একটু বেশি। সেখানে ভক্তজনের সমাবেশ হত এককালে।
দুটি অংশ এই মন্দিরের– সামনে অলিন্দ আর পিছনে গর্ভগৃহ। অলিন্দটি ছিল তিন-দুয়ারী। কোনও চিহ্নই নাই আজ আর সেটির। সেবায়তগণের সাথে সাক্ষাৎকারে জানা যায়, দ্বারগুলি রচিত হয়েছিল খিলান-রীতিতে। দুটি পূর্ণ-স্তম্ভ আর দুই প্রান্তে দুটি অর্ধ-স্তম্ভের সাহায্যে দ্বারগুলি রচিত হয়ে থাকে। এই মন্দিরের স্তম্ভের গড়ন কী ছিল, আজ আর তা জানবার অবকাশ নাই কোনো।
অলিন্দের পিছনের অংশে তিনটি কক্ষ– মাঝখানে প্রশস্ত কক্ষটি গর্ভগৃহ, সেখানেই দেবতার বিগ্রহ বিরাজিত থাকতেন। দু’দিকের দুটি ছোট কক্ষ ভোগঘর এবং তৈজসঘর হিসাবে ব্যবহার করা হত। অলিন্দের ভিতরের ছাদ বা সিলিং নির্মাণ করা হয়েছিল টানা-খিলান রীতিতে। গর্ভগৃহের দু’দিকের দুটি দেওয়ালে দুটি বড় খিলান নির্মাণ করে, টানা-খিলান করে সিলিং হয়েছিল পিছনের তিনটি কক্ষেই।
মন্দিরের সামনের দেওয়ালটি সম্পূর্ণ অবলুপ্ত। সেকারনে, তার মাথায় আলসের উপর শীর্ষক বা চূড়াটি কেমন গড়নে রচিত হয়েছিল, তা আর জানা যায় না। জানা যায় না, সেখানে আমলক, কলস, বিষ্ণুচক্র ইত্যাদির বিন্যাস করা হয়ে ছিল কি না, তা-ও।
মন্দিরে বিগ্রহ ছিলেন রাজরাজেশ্বর নামিত শালগ্রাম শিলা। দেবতার রথযাত্রার প্রচলন করা হয়েছিল। সেকারণে, একটি স্নানমন্দির গড়া হয়েছিল মূল মন্দিরের সামনেই। ত্রি-রথ বিন্যাস করা শিখর-দেউল রীতির ছোট আকারের মন্দির। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সওয়া ৬ ফুট, উচ্চতা পৌনে ১৫ ফুট। জীর্ণ মূলমন্দির থেকে বিগ্রহ সেখানেই রেখে সেবাপূজার ব্যবস্থা হয়েছে।
রাসমঞ্চটি নির্মিত হয়েছিল শ’দেড়েক বছর আগে। তারিখের উল্লেখ আছে প্রতিষ্ঠালিপিতে– বাংলা ১২৮১ সন বা ইং ১৮৭৪ সাল।
মাঝারি মাপের নব-রত্ন রীতির অষ্ট-দ্বারী সৌধ। রত্নগুলি নির্মিত হয়েছে বেহারী রসুনচূড়া আকৃতিতে। পাদপীঠ বেশ উঁচু।
মন্দির কিংবা রাসমঞ্চ– কোনো সৌধেই কোন অলঙ্করণ নাই।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী শরদিন্দু গুহরায়, বিমলেন্দু গুহরায়, নির্মলেন্দু গুহরায়, অতনু গুহরায়, শান্তনু গুহরায়, মানস কুমার দাস– সাঁকোয়া।
যাওয়া-আসা : মেদিনীপুর বা খড়্গপুর থেকে দক্ষিনমুখে বেলদাগামী রাস্তায় বেনাপুর। সেখান থেকে পূর্বমুখে ৫ কিমি দূরে সাঁকোয়া গ্রাম এবং গুহরায় বংশের বসবাস এবং মন্দির।