নিজস্ব সংবাদদাতা: যদু মধুকে দেখায় আর মধু যদুকে! ওদিকে কিলোমিটারের পর কিলোমিটারের খানাখন্দ কাদা আর পাঁক মাখা রাস্তা পড়ে থাকে মাসের পর মাস এমনকি বছর গড়িয়ে যায়। ছোট বড় মাঝারি কোনও নেতাই পথের পথ খুলতে পারেনা। এভাবেই পড়ে ডেবরা থানার আষাঢ়ি থেকে হিজলদা। কাদা ভেঙে নেতাদের বাড়ির উঠোন কাদা করে দিয়ে যখন রাস্তার কপাল খুলেছিলনা তখন অসাধ্য সাধন করলেন এক ডাক্তার বাবু, ১২দিনেই শুরু হয়ে গেল ২ বছর বন্ধ থাকা রাস্তার কাজ। পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা থানার গোয়ালগাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ডঃ সুমিত সুর অবশ্য এখন বাঁকুড়ার পাত্রসায়রে থাকেন,সেখানকার ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক তিনি। সেই ডাক্তার বাবুর দেখানো পথেই খুলল ডজন খানেক গ্রামের কপাল।
আষাঢ়ি থেকে হিজলদা দুবছর ধরে আটকে থাকা সড়ক যোজনার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছিল অজানা কারণে। এই রাস্তার দুর্দশা প্রকাশ করেছিল ‘দ্য খড়গপুর পোষ্ট’। ১৭ই সেপ্টেম্বর প্রকাশিত সেই সংবাদেই বলা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার আওতায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এই রাস্তার জন্য লড়াইটা শুরু করেছিলেন দ্বারপাড়া গ্রামের এক শিক্ষক মোহন মন্ডল। মোহনবাবু বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন পড়ুয়াদের শিক্ষক এবং নিজেও থাকেন জেলার বাইরে।
মোহনবাবুর কথায়, ‘প্রায় দেড় বছর লড়াই করেছি রাস্তাটার জন্য। বিভিন্ন দিকে চেষ্টা, আবেদন নিবেদন, চিঠি চাপাটি করে প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। ততদিনে মরচে পড়ে গেছে প্রকল্পের বোর্ডে। এই সময় বিষয়টি জানিয়েছিলাম ডেবরারই এক শিক্ষক, সমাজসেবি দুরন্ত দাস মহাশয়কে। দুরন্তবাবুই খোঁজ দিলেন ডঃ সুমিত সুরের। তাঁরই কথা মত আমরা শুধু তিনটি মেল করেছিলাম। ব্যাস, তাতেই কেল্লা ফতে। ২৫শে সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে গেছে রাস্তার কাজ।
ডঃ সুমিত সুর জানিয়েছেন, ‘দেখুন এটা একটা কেন্দ্রীয় প্রকল্প। আমার অভিজ্ঞতা বলে এই ধরনের প্রকল্পের একটি কেন্দ্রীয় তত্ত্বাবধায়ক দল থাকেই। গ্রামীন সড়ক যোজনা বা প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনারও একটি নোডাল টিম থাকে। ওদের একটি ওয়েব পোর্টালও আছে। গোটা বিষয়টি অনলাইন ট্র্যাকিংয়ে থাকে। অর্থাৎ সমস্তটাই নজরদারিতে থাকে। আমি যেহেতু ওই এলাকার উপভোক্তা নই তাই ওখানকার বাসিন্দাদের দিয়েই কেন্দ্রের গ্রমীন সড়ক যোজনা দপ্তর, রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামীন উন্নয়ন মন্ত্রক এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাশাসককে মেল করাই। পাশাপাশি ওই ওয়েব পোর্টালে রাস্তার বর্তমান অবস্থার ছবি তুলে আপলোড করে দেওয়া হয়। ১৩ই সেপ্টেম্বর আমরা মেল করেছিলাম। ১৪ই সেপ্টেম্বর দিল্লি আমাদের জানায় বিষয়টি নিয়ে জেলা শাসকের সঙ্গে কথা বলছেন। এর কয়েকদিনের মধ্যেই আধিকারিকরা এসে ফের রাস্তার মাপজোক শুরু করেন। ২৫তারিখ থেকে কাজ শুরু হয়ে গেছে।”
ডাক্তারবাবুর এই লড়াইটা অবশ্য রপ্ত করেছেন আরো আগে। ২০১৭ সালে তিনি যখন রিসার্চ ফেলো তখন বাড়ি থেকে রাধামোহনপুর স্টেশনের এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় পড়ে গিয়ে আহত হতে দেখেছিলেন এক মা ও তাঁর ছোট্ট মেয়েটিকে। তারপরই রেলের জন অভিযোগ দপ্তরে ট্যুইট করেন। রেল জানায়, দেখছি। কিন্তু ফের চাপা পড়ে যায় বিষয়টি। কিন্ত হাল ছাড়েননি ডঃ সুর। টানা ২বছর শুধু ট্যুইট করেই রেলকে বাধ্য করেছেন সেই রাস্তা করতে। অনেকেই জানেননা রাধামোহনপুর রেলস্টেশন থেকে স্টেট ব্যাঙ্ক অবধি রেলের বানিয়ে দেওয়া ঝকঝকে রাস্তাটি কেবলমাত্র তাঁর একার লড়াইয়ে হয়েছে। ডঃ সুর জানান, ” কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত বা দলগত বিবাদে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। আমার কাজটি করাতে হবে। শুধু খুঁজে নিতে হবে কাজটির মূল দায়িত্ব কার?এবার সেখানেই আমাদের অসুবিধার কথা জানানো। দুরন্ত বাবু মোহনবাবুদের আমি শুধু সেই পথটাই বাতলে দিয়েছি।”
শুধু রাস্তা নয়, ডাক্তারবাবুর পথেই নিজেদের গ্রামের বৈদ্যুতিক কেবল সংযোগের সমস্যাও ঠিক করে নিয়েছেন মোহন মন্ডল। কেবললাইন টানার সময় লম্বা দূরত্বে খুঁটি পুঁতে কেবল টেনে পালিয়েছিল ঠিকাদার। গ্রামবাসীদের আপত্তি গ্রাহ্য করেনি। সেই কেবল ঝুলে পড়ে রাস্তার ওপর। এবার বিদ্যুৎ দপ্তরের সংঙ্গে যোগাযোগ। বিদ্যুৎ দপ্তরের পশ্চিম মেদিনীপুর ডিভিশনাল ম্যানেজার দিলীপ কুমার বাছারের হস্তক্ষেপে ফের খুঁটি ফেলেছে ঠিকাদার। সব মিলিয়ে খুশি ১৫/১৬টি গ্রামের মানুষ। ডাক্তারবাবুর তাঁরা জানিয়েছেন অন্তরের কৃতজ্ঞতা। মোহন মন্ডল জানিয়েছেন, আমাদের এই লড়াইয়ে জয় আসতইনা যদি ডাক্তারবাবু না থাকতেন। (আটকে থাকা সেই রাস্তার খবর যা আমরাই প্রথম প্রকাশ করেছিলাম। পড়তে ক্লিক করুন: )