Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-- ৩৩ ॥ চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৩৩ ॥ চিন্ময় দাশ

               

  জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল

                            চিন্ময় দাশ 

বিষ্ণু মন্দির, পলাশপাই (দাসপুর)
শিলাবতী কংসাবতী আর রূপনারায়ণ– তিন নদীর জলধারায় পুষ্ট হয়েছে চেতুয়া পরগনা। সেটিই আজকের দাসপুর থানা। চেতুয়ার রাজা শোভা সিংহ তাঁর রাজ্যে কৃষি এবং হস্তশিল্পের বিকাশের জন্য বহু কাজ করেছিলেন। তাঁর অধীনস্থ এক জমিদার ছিলেন বঙ্গরাম চৌধুরী। গ্রামীণ শিল্পের বিকাশে প্রভূত অবদান ছিল তাঁর। দাসপুর এলাকার শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল বস্তুত তাঁর সময়েই।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
তাঁর সময়েই লোহা-পিতল শিল্প, পট ও শঙ্খশিল্প, মাদুর-মসলন্দ, রেশমশিল্প, বিষাণশিল্প, তাঁত শিল্প ইত্যাদিতে দাসপুর এলাকার অর্থনীতি অত্যন্ত পুষ্ট হয়েছিল। তবে বড় অবদান ছিল রেশম শিল্পের।
সবচেয়ে বেশি বিকশিত ও উন্নত ছিল গুটিপোকার চাষ ও রেশমের বয়ন। এই শিল্পের কথা ছড়িয়েছিল একেবারে দুনিয়া জুড়ে। ইংরেজ, ফরাসি, ওলন্দাজ বণিকেরা এসে দখল করে নিয়েছিল শিল্পটিকে। মেসার্স ওয়াটসন কোম্পানি, মেসার্স লুইস পাইন এন্ড কোম্পানির নাম আজও প্রবীণদের মুখে শোনা যায়।

বিদেশী বণিকদের ভূমিকা স্থানীয় চাষিদের স্বার্থে ঘা দিয়েছিল, সে ঠিক কথা। পাশাপাশি, বৃহত্তর বাজারের সন্ধানও দিয়েছিল রেশমশিল্পটিকে। ভারত ছাড়া, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও রেশম রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল সেসময়। সেটা ছিল ইউরোপীয় বণিকদেরই অবদান।
সেই সুবাদেই ছোট-বড় বহু ব্যবসায়ীর উদ্ভব হয়েছিল চেতুয়া পরগণা জুড়ে। তাঁদের অনেকেই রেশমের ব্যবসা থেকে ধনী হয়ে উঠেছিলেন।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
কংসাবতী নদীর একটি শাখা পূর্বমুখে এসে রূপনারায়ণের সাথে মিশেছে। পলাশপাই খাল তার নাম। সেই জলধারা ছুঁয়েই দাসপুরের এক গ্রাম পলাশপাই। এখানে মাইতি পদবীর একটি পরিবারও রেশম ব্যবসায় নেমেছিল। তা থেকে প্রভূত ধনী হয়ে উঠেছিল পরিবারটি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার সুবাদে একটি জমিদারীও করেছিলেন তাঁরা। ইং ১৮৩৪ সালে তাঁরা বড় মাপের এই মন্দিরটি গড়েছিলেন  কুলদেবতা বিষ্ণুর জন্য। শ্রীধর জীউ নামে একটি শালগ্রাম শিলা পূজিত হয়।

মন্দিরের প্রতিষ্ঠা-ফলকে জনৈক গোবিন্দরাম মাইতির নাম উল্লেখ আছে। তবে, সেবাইত পরিবার বলেন, পরাণ মাইতি নামে নিঃসন্তান  এক সহোদর ছিলেন গোবিন্দরামের। উভয়ে যৌথভাবে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট। এত উঁচু মন্দির এই থানায় দেখা যায় না। শিখর-দেউল রীতিতে নির্মিত। তবে জগমোহন, নাটমন্দির, ভোগমন্ডপ অংশগুলি নাই. কেবল বিমান অংশটিই নির্মিত হয়েছে।
উঁচু পাদপীঠ। তাতে প্রশস্ত প্রদক্ষিণ-পথ। তার উপর ইটের তৈরী দক্ষিণমুখী মন্দির। সামনে অলিন্দে ত্রি-খিলান দ্বারপথের অলিন্দ। তার সিলিং হয়েছে টানা-খিলান করে। দ্বিতল-বিশিষ্ট মন্দির। উপরে নীচে দুটি গর্ভগৃহই প্রমান সাইজের। দ্বারপথ একটি করে, খিলান-রীতিরই।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
কেবল আকারে বড় নয় এই মন্দির। বিপুল টেরাকোটা ফলকের গৌরবে গরীয়ান দেবালয়টি। অজস্র ফলক মন্দির জুড়ে। সবই টেরাকোটার। সবই বড় আকারের। চতুর্মুখ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, রাধা-কৃষ্ণ, গণেশ-জননী, দশভুজা দূর্গা, কার্তিক, গণেশ, দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা, দশানন রাবণ– বহু মূর্তি এখানে। আছে কয়েকটি মিথুন-মূর্তিও। দুটি দ্বারপাল-মূর্তি আছে মন্দিরে। তবে, সেগুলি গর্ভগৃহের দেওয়ালে নয়, অলিন্দের স্তম্ভে রচিত হয়েছে। একান্তই ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। 

কথায় বলে– নদীর ধরে বাস, ভাবনা বারো মাস। এখানে হয়েছে সেই বিপদ। বন্যার ভয় থেকে বাঁচতে, বাঁধ গড়া হয়েছে নদীর পাড়  জুড়ে। তাতে মন্দিরের অর্ধেকের বেশি অংশ ঢেকে দেওয়া হয়েছে মাটি ফেলে। মন্দিরের নীচের তলার তো সামনেরটুকু ছাড়া, কিছুই আর বেঁচে নাই। এমন অবিবেচক কাজ হতে পারে, ভাবা যায় না। এমন অনুপম শিল্পকর্মগুলিকে ধ্বংস করে দিতে হাত কাঁপেনি আমাদের।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
বহু টেরাকোটা ফলকে সাজানো একটি রাসমঞ্চও আছে এই পরিবারের। ‘ বেহারী রসুনচূড়া ‘র নব-রত্ন রীতির। আটটি দ্বারপথ। প্রতিটির দুপাশে একটি করে বাদিকা মূর্তি। এছাড়া কার্ণিশের নীচ বরাবর দুটি করে সারিতে অজস্র ফলক। সপরিবার শিব-দুর্গা, মা-যশোদার দধিমন্থন ইত্যাদি সবই পুরাণ-কাহিনী নির্ভর মোটিফ।
মন্দির আর রাসমঞ্চ– দুটিই ভারী জীর্ণ। দুটিই দ্রুত অবলুপ্তির পথিক।
যাওয়া-আসা: পাঁশকুড়া স্টেশন বা মুম্বাই রোডের মেচগ্রাম থেকে ঘাটালগামী পথে গৌরা। সেখান থেকে পূর্বমুখে ৫/৬ কিমি দূরে পলাশপাই। নদীর দক্ষিণ পাড় ধরে, পথের উপরেই মন্দির।
প্রচ্ছদ-রামকৃষ্ণ দাস

RELATED ARTICLES

Most Popular