নিজস্ব সংবাদদাতা: বাবা ঠিকার কাজ করে। কাজ হলে পয়সা নয়ত নেই। করোনা কালে জরা জীর্ন হয়ে গেছে সংসার। সেই মেয়ে কিনা অংকে একশোয় একশ! ইতিহাসে নব্বই, ভূগোল একানব্বই, বাকি বিষয় গুলি চুরাশি করে। মাধ্যমিকের এই ফলের পর উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হয়েছে বটে কিন্তু অন লাইনের যুগে পড়াশুনাটা চলবে কী করে? বাড়িতে একটা ছোটখাটো, সস্তার মোবাইল কিনে দেওয়ার কথা বলতে গিয়েও বলতে পারেনি পুজা। বাড়িতে সে একা নয়, আরও সদস্য আছে। তার জন্য একটা মোবাইল কিনতে হলে বাকি পরিবারের এক মাসের খাওয়া দাওয়া বন্ধ। খড়গপুর গ্রামীন থানার ঘাগরা এলাকার বাসিন্দা পুজা দে তাই ইতি টানতেই চলেছিল পড়াশুনা।
খড়গপুর রবীন্দ্রপল্লীর বাসিন্দা প্রিয়াঙ্কা দে এবছরই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে। বাবা পুরোপুরি অন্ধ, বাড়িতে কয়েকটা গরু রয়েছে। অন্ধ বাবা লাঠি ঠুকে ঠুকে সেই গরু নিয়ে মাঠে চরাতে যায়। দুধ বিক্রি করে চলে সংসার। করোনা কালে সেই দুধ বিক্রি করাই মুশকিল হয়ে গেছে। এমন মেয়ের কলেজে পড়ার চিন্তা করাটাই স্পর্ধার। ভর্তি হয়েও তাই থমকে গেছে পড়াশুনা।
খড়গপুরের দীনেশ নগরের বাসিন্দা মাধ্যমিক পাশ করা অঙ্কন মৃধার বাবা-মা নেই। অনাথ জীবনের মাথার ওপর দিদি-জামাইবাবু। নিজেদেরই সংসার টানতে হিমশিম খাওয়া দিদি-জামাই বাবুর পরিবার থেকে আলাদা করে একটা মোবাইল চাওয়া ধৃষ্টতা ছাড়া আর কী? প্রায় এরকমই অবস্থা তালবাগিচার
সমরেশ মৃধার। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হওয়া ছেলেটার বাবা মা উভয়েই ঠোঙ্গা বানিয়ে সংসার চালান। মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়া সুমন পালের বাবা করোনা কালে মুখ থুবড়ে পড়া ডেকরেটার কর্মী।
সারাদেশ জুড়ে অতিমারির যুগে যখন অন লাইন পঠন পাঠনের জামনা শুরু হয়ে গেছে তখন এই হত দরিদ্র পরিবার গুলির মেধাবী পড়ুয়াদের জন্য ভাবনা কোথায়? খবর কাগজে উঠে এসেছে অভাবী পরিবার মোবাইল কিনে দিতে না পারায় মেধাবী পড়ুয়ার আত্মহত্যার ঘটনা কিন্তু যেটা উঠে আসেনি তা হল মোবাইলের অভাবে দরিদ্র ভারতের লক্ষ লক্ষ মেধাবীরা ছিটকে যাচ্ছে পড়াশুনার ট্র্যাক থেকে। শনিবার, ২৬ শে সেপ্টেম্বর বাঙালির শ্রেষ্ঠ মনীষা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০১ তম জন্ম দিনে এরকমই ৫জন অভাবী মেধাবীর হাতে মোবাইল তুলে দিল খড়গপুর শহরের ভগৎ সিং জন্ম শত বার্ষিকী কমিটি।
কমিটির কার্যালয় লাগোয়া তালবাগিচা যুব সঙ্ঘ দুর্গামন্দির মাঠে এদিন একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয় যার শিরোনাম ছিল, বিদ্যাসাগরের সমাজ ভাবনা ও আজকের ভারত। আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন খড়গপুর কলেজ ও আইআইটি খড়গপুরের প্রথিতযশা প্রাক্তন অধ্যাপক সুদর্শন পাল, সিদ্ধার্থ সেন। উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যাপক বিপ্লব বাগচী, আইআইটির অধ্যাপক মানস লাহা। আলোচকরা মূল আলোচনার পাশাপাশি প্রশংসিত করেছেন এই উদ্যোগের। বলেছেন, “বিদ্যাসাগরের বহুমুখী কাজের মধ্যে প্রধানতম কাজটি ছিল মানুষকে উচ্চ উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের চলতে সাহায্য করা। টাকার অভাবে কারও পড়া বন্ধ হয়েছে জানলে তিনি বাড়িয়ে দিতেন সাহায্যের হাত। ভগৎ সিং জন্ম শত বার্ষিকী কমিটি সেই কাজটিই করেছে। সময়ের দাবি এটাই। সমাজকে আরও সমৃদ্ধ করতে হলে দেশের কোনায় কোনায় পড়ে থাকা অভাবী মেধাবীদের খুঁজে আনতে হবে, সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে হবে। যে দেশের প্রতিভা শুধু সম্পদশালীর ঘরেই বিকশিত হয় সে দেশের উন্নতির আকাশ থেকে কালো মেঘ কোনও দিনই সরে যায়না।”
নিজের জন্য একটা দামি স্মার্ট ফোন হাতে পেয়ে আবেগ আপ্লুত পূজা, প্রিয়াঙ্কা, অঙ্কন, সমরেশ, সুমনরা জানাল, পড়াশুনার লাইনটা অন করে দিল ভগৎ সিং জন্ম শত বার্ষিকী কমিটি এবার ফের শুরু হবে যাত্রা। কমিটির সম্পাদক প্রদ্যোৎ দাশগুপ্ত বলেন, “ইচ্ছে আছে আরও অনেকের হাতে ধিরে ধিরে তুলে দেব স্মার্টফোন। সবাইকে আবেদন করেছি সাহায্য মত সাহায্য করুন। পথ খুলে যাক সবার পড়াশুনার।”