Homeসাহিত্যরবিয়াণীএকটি হলুদ রবিবারে

একটি হলুদ রবিবারে

✍️কলমে: আশিস মিশ্র

(পর্ব–১৪)

এখন যে কোনো রবিবারই বড্ড অস্থির হয়ে থাকি। হে পরমপূর্ণ, তখন তোমার চরণ স্মৃতিতে ফিরে আসে বারবার। ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায় আমার সকল অহংকার। কান পেতে শুনি সেই সব চরণধ্বনি—
” নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক
এল মহাজন্মের লগ্ন
আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত
ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন…।”

” অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।”

” অদৃষ্টেরে শুধালেম–চিরদিন পিছে
অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে
সে কহিল –ফিরে দেখ, দেখিলাম আমি
সন্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি।”

 

 

তারপর প্রায় পাথর হয়ে বসে থাকি। পাথর থেকে কোনো রূপ আর প্রকাশিত হয় না। স্মৃতিতে ডুব দিই।
সেই কতো বছর আগে। হলদিয়া উৎসবের সেমিনার মঞ্চে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কবিগুরুকে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করছেন। যেন সমস্ত অবসন্নতা দূর হয়ে যাচ্ছিল। এমন করেও কবিগুরুকে চেনানো যায়!

তারপর শ্রদ্ধেয় সুদীন চট্টোপাধ্যায় ও শ্রদ্ধেয় শুভঙ্কর চক্রবর্তীর দুটি ভাষণ শুনেছি আমাদের বিশ্ব বাংলা কবিতা উৎসবে। সে- সব দিন স্মরণীয় হয়ে আছে। তারপর এতোদিন কেটে গেছে। আবার একটি সুযোগ এলো। পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ে বি এড কলেজে কবিবন্ধু অরুণ ভট্টাচার্যর আহ্বানে আমি, কবি পার্থসারথি গায়েন, দেবাশিস প্রধান, বিধানেন্দু পুরকাইত, রবীন বসু, মনোতোষ আচার্য সহ আরও কয়েকজন বন্ধু ২২ শে শ্রাবণ অনুষ্ঠানে হাজির হলাম। পার্থদাকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো। তিনি রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রেক্ষাপট আলোচনা করলেন। অসাধারণ সেই আলোচনা, যেন চোখের সামনে সব ঘটনা দেখতে পাচ্ছিলাম।

 

তারপর সেখান থেকে এগরায় চক্রধর দাসের
‘ কথাছন্দ’ -র ২২ শে শ্রাবণ অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম। সেখানে পার্থদা ১ ঘন্টার বেশি কবিগুরুর মৃত্যচেতনা ও তাঁর মৃত্যুঞ্জয় হয়ে থাকার ঘটনা বললেন। সে এক অপূর্ব আলোচনা।
এই কথাগুলি এই কারণে বললাম, যে কবিগুরুকে নিয়ে যা কিছু অসভ্যতা ঘটছে সাম্প্রতিক কালে, তার দিকে আগ্রহ না থাকলেও, আগ্রহ তৈরি হয়ে যায়। তখনি কাউন্টার করতে হয়। তবুও একটি মাধ্যম থেকে বেরিয়ে আসা যায় না সহজে। তাই আমরা যারা মুখোমুখি প্রতিবাদে যেতে পারছি না, তখন আমাদের ভারচুয়ালি প্রতিবাদ করতে হয়।

 

২০১৭,১৮,১৯ পরপর শান্তিনিকেতন যেতে হয়েছে। নানা কাজে। থাকতেও হয়েছে। অজয় পেরিয়ে বোলপুর রাস্তায় একটি তোরণ দেখে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে গেলো। আমাদের বন্ধুরা তোরণের ছবিটি তুলে রাখলো। তোরণটিতে মাননীয় এক দাদার বেশ সুন্দর দুটি ছবি। গাড়ি ছুটছে। আর আমাদের আলোচনায় কিন্তু দাদা ঢুকে পড়েছেন। তিনি নানাসময়ে বিস্ফোরক কথাবার্তা বলে খবরের শিরোনামে এসেছেন। এখনো আসেন। এই মানুষটি ব্যক্তি জীবনে কতটা সুখী? কেউ তা জানেন। কেউ তা জানেন না। তিনি একবার শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতা নিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন। খুব হৈচৈ হয়েছিল। জানি না কতজন বুদ্ধিজীবী সেদিন শঙ্খবাবুর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বা তার প্রতিবাদে কলকাতায় কোনো মিছিল হয়েছিল কিনা। জানা নেই।
এখন সত্যি তো,সেই দাদা খুব একটা বাজে কথা বলেননি সেদিন। কারণ তিনি তো কবি বলতে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামকেই জানেন। শঙ্খ ঘোষ কে? এটা শঙ্খ ঘোষ বা দাদার কোনো দোষ নয়। দোষটা আমাদের শিক্ষা ও জ্ঞানের। কে কতটা জানি। আমাদের ঘরের শিক্ষিত বাচ্চারা অনেকেই এখন বঙ্কিমচন্দ্র বা শামসুর রাহমানের নামই বলতে পারে না। এটাই সত্যি। তার মানে সেই কথা– ‘বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকু জানি’–।

 

 

শুধু দাদা বললেই দোষ? কেন আমাদের ঘরের বাচ্চারা, যারা রবীন্দ্রভারতীতে পড়ছে, তারা যখন কবিগুরুর চাঁদ আর গগন নিয়ে ক্যাম্পাস ফাটিয়ে দিলো, তার বেলা? তারা তো শিক্ষিত। অজ্ঞান নয়।দাদা না হয় রাজনীতি করেন, নানা চাপে থাকেন, তাই হয়তো তাঁর মাথার ঠিক থাকে না। আজেবাজে বলে বসেন। আর সেই খবর খুব খায় মানুষ। তাই তিনি প্রচারের আলোয় থাকেন। কিন্তু আমাদের বাচ্চারা কী তেমন চাপ অনুভব করে? তা কি নিজেদের জীবনের প্রতিষ্ঠা পাওয়া, না -পাওয়ার চাপ? তার বাইরেও চাপ। কতোরকম চাপ। এই চাপাচাপিতে তারা কখন যে কী করে বসে, বোঝা মুশকিল। কিন্তু সে-সবও দেখে আমরা অনেকেই বেশ মজা পাই। আলোচনার খোরাক হয়ে ওঠে। সেই সব অসভ্যতা ভারচুয়ালি দেখে দাঁত কেলাই।

 

 

যেমন এখন কেউ কেউ বিশ্বভারতী কান্ড নিয়ে দাঁত কেলাচ্ছেন। কেউ কেউ প্রতিবাদে ঝাঁপিয়েছেন। আমার খালি মনে হচ্ছে কবিগুরুকে জানা শান্তিনিকেতনে বসবাস কারি মানুষগুলির কথা। তাঁরা কী করছেন এখন? তাঁরা কি এই গানটি শুনছেন?
” ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে / ও বন্ধু আমার–“।

কখনো ভিড়, বা কোলাহলে আমার পছন্দ নয়। তাই কোনো বড়ো উৎসবে আমি শান্তিনিকেতনে যাই না। একবারই কলাভবনের নন্দন মেলায় যাই। যতবার গিয়েছি, তা প্রায় কোনো মেলা ছাড়াই। জীবনের প্রথম একা একাই যেতাম সেখানে। তারপর মাঘ মেলায় কবিতা পড়তে যাওয়া। আরও কতো কবিতার আসরের ডাক পেয়েছি। একবারও যাওয়া হয়নি। একা একা ওখানে থাকার,দেখার আনন্দটাই আলাদা। দলগত ভাবে গিয়েও আনন্দ পেয়েছি। কখনো প্রবীরদা, কখনো পরাণ মন্ডল, কখনো অনিমেষ মন্ডল, বিষ্ঞুদার সঙ্গে আড্ডা, আরও কতো আড্ডা — সে -সব ভুলবো না। একবার বুদ্ধদেব গুহর বাড়িতে সারাদিন আমি, কমল, রঞ্জন, সুমন সহ কয়েকজন বন্ধুর তুমুল আড্ডা। বুদ্ধদার সেই আতিথেয়তা সারাজীবন মনে থাকবে। দামী হুইস্কির সঙ্গে কতরকম মাছ। সে এক অসামান্য দুপুর। কতো কথা।

আর একবার তমালিকাদি সহ একটি বড়ো দল গেছিলাম। সারারাত বাউল গান। প্রান্তিকে থাকা। সেদিনের কথাও ভোলা যায় না।

যতবার গিয়েছি, ততবারই ছুঁয়ে এসেছি শনিবারের হাট,সোনাঝুরি, উত্তর বিশ্বাসের সঙ্গে আড্ডা, এবং ভুবনডাঙা। এই ভুবনডাঙা নিয়ে বেশ কিছু কবিতাও লিখেছি। সত্যি, ওই মাঠে দাঁড়ালে আমার লেখা চলে আসে। অন্ধকারে, কখনো চাঁদের আলোয় হঁটেছি।
সেই ভুবনডাঙা কী আর আগের মতো আছে? না তাকে ভালো থাকতে দেওয়া হবে? এটাই এখন বড়ো প্রশ্ন।

 

 

বাঙালি তো নতুন কিছু গড়বার স্বপ্ন দেখে। তার রূপও দেয়। কেন যে এখন বাঙালি সব ভেঙে দিতে চায়, কবে থেকে তাদের মানসিকতায় “ভাঙার কালচার ” এলো? এই অসহিষ্ণু বাঙালি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জানি না। ‘ ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ এই শ্লোগান কি সামাজিক?
এই হিংসা থাকবে না আমরা হিংসামুক্ত হবো? আমার সমস্ত স্নায়ু এই সব দেখে দেখে যখন ক্লান্ত, তখন বই নিয়ে বসি। চিত্রশিল্পী কে. জি. সুব্রহ্মণ্যন -কে নিয়ে সাক্ষাৎকারের বইটি আবার পড়লাম। লেখক সৌরভ দে ও দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়ের প্রশ্নের উত্তরে শিল্পী বলছেন — ” ১৯৪০ সালে গান্ধীজি একবার এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ বোধ হয় বুঝতে পারছিলেন তাঁর আয়ু আর বেশিদিন নেই। গান্ধীজির চলে যাওয়ার মুখে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে একটা চিরকুট দিয়েছিলেন। চিরকুটের বিষয় ছিল এরকম — গান্ধীজি যেন শান্তিনিকেতনের পাশে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ অনুগ্রহ নেওয়ার ব্যাপারে লজ্জিত ছিলেন। তাই, সরাসরি মুখে কিছু না বলে তাঁর এই চিরকুট – লিখন। গান্ধীজি সেটা পড়ে রবীন্দ্রনাথকে আশ্বস্তও করেছিলেন। ”
তিনি আর একটি উত্তরে বলছেন– ” ১৯৫২ সাল নাগাদ বিশ্বভারতী সরকারি অনুদান লাভ করেছিল। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সেটি এখন চলছে। কিন্তু অনেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন, বিশ্বভারতীর একটা আলাদা সোশ্যাল স্টেটাস থাকবে! ”

 

 

সত্যি তে তাই। বিশ্বভারতী আমাদের কাছে গর্বের। গোটা পৃথিবীকে সে ধারণ করে। তার সোশ্যাল স্টেটাস অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু এই যে সামাজিক কোলাহল, এই যে তার চারপাশে এতো অসহিষ্ণুতার আবরণ দিন দিন বাড়ছে, যার ফলে মনে হয়, ওখানকার টান, মায়া ক্রমশ কমছে না তো? এই বাংলার অনেককিছু দেখার আছে। অনেক জায়গায় যাওয়ার আছে। কিন্তু ওখানে যাওয়ার যে তীব্র টান, তাতে কোথাও একটা ফাটল তৈরি হচ্ছে না তো? এ আমার কষ্টের কথা। আপনাদের অনুভব অন্যরকম হতে পারে। সে যাই হোক, এখন আবার সেই তাঁর কথাই তো স্মরণে আসে –” প্রবলতার মধ্যে সম্পূর্ণতার আদর্শ নেই, সমগ্রের সামঞ্জস্য নষ্ট করে প্রবলতা নিজেকে স্বতন্ত্র করে দেখায় বলেই তাকে বড় মনে হয়, কিন্তু আসলে সে ক্ষুদ্র।…
ঝড় কেবল সংকীর্ণ স্থানকেই কিছুকালের জন্যে ক্ষুব্ধ করে, আর শান্ত বায়ুপ্রবাহ সমস্ত পৃথিবীকে নিত্যকাল বেষ্টন করে থাকে…
প্রত্যেক মানুষ জীবনের কর্মের দ্বারা সংসারকে কিছু না কিছু দান করছে, কিছুই নষ্ট হতে দিচ্ছে না — কিন্তু মানুষ যখন সেই সঙ্গে অহংকেই চিরন্তন করে রাখতে চাচ্ছে তখন তার চেষ্টা বৃথা হচ্ছে। এই যে জীবনটা ভোগ করা গেল, অহংটিকে তার খাজনাস্বরূপ মৃত্যুর হাতে দিয়ে হিসেব চুকিয়ে যেতে হবে….।”

RELATED ARTICLES

Most Popular