রাধাবল্লভ মন্দির, নজরগঞ্জ (মেদিনীপুর শহর)
চিন্ময় দাশ
চতুর্দশ শতকের প্রথম দশকের ঘটনা। দিল্লী দখল করেছেন তুর্কী সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজী। দাক্ষিণাত্য অভিযানের আগে, বারংবার গুজরাট এবং রাজস্থানের উপর আক্রমণ সগঠিত করছিলেন তিনি। এদিকে ত্রয়োদশ শতক থেকে শোলাঙ্কি সম্প্রদায়ের একটি শক্তিশালী শাখা গুজরাটের বিশাল এলাকা শাসন করছিল। তাঁদের আদি পুরুষের নাম মহাবীর শুক্ল।
মহাবীরের এক অধস্তন পুরুষ কর্ণদেবের শাসনকালে, আলাউদ্দিন তাঁর রাজ্য আক্রমণ করে কর্ণদেবকে হত্যা করেন। রানী ও রাজকুমারীকে বন্দী, ধর্মান্তরিত এবং বিবাহে বাধ্য করা হয়। সেসময় লুঠতরাজ, দেবালয় ও দেববিগ্রহ ধ্বংস, প্রাণহানি এবং সর্বোপরি ব্যাপকহারে ধর্মান্তর করা চলতে থাকে। এই পটভূমিকায়, প্রাণ এবং স্বধর্ম রক্ষার তাগিদে, শোলাঙ্কি রাজপুরুষেরা তীর্থ দর্শনের নামে, দলে দলে রাজপুতানা ত্যাগ করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন।
শোলাঙ্কিদের একটি বাহিনী অযোধ্যা, হরিদ্বার, মথুরা, বৃন্দাবন, কাশী, গয়া ঘুরে, পুরীতে পৌঁছায়। সেখানে জগন্নাথ দর্শন সেরে গঙ্গাসাগর যাত্রার পথে, মেদিনীপুর জেলায় প্রবেশ করে কেদারকুণ্ড পরগণায় আসে। জনশ্রুতি আছে, এখানে দলের নেতা বীর সিংহ দেবী চন্ডীকার স্বপ্নাদেশ পেয়ে যাত্রাবিরতি ঘটান। বীরসিংহপুর (বর্তমান ডেবরা থানা) গ্রাম পত্তন করে, স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। ময়ূরভঞ্জের রাজার ‘তসেলা’ (আবাদী সনদ) নিয়ে জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বীরসিংহ।
পরে, বাংলার নবাব সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ওডিশা অভিযানের পথে, বীরসিংহকে আক্রমণ ও হত্যা করে, নির্বিচার হত্যালীলা ও ধর্মান্তর করতে থাকেন। সেকারণে, শোলাঙ্কিরা পুণরায় প্রাণ এবং স্বধর্ম রক্ষার জন্য, কেদারকুন্ড পরগণা ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। সেসময় অতি সংগোপনে ক্ষত্রিয়-চিহ্ন উপবীত এবং কৌলিক পদবী ‘সিংহ’ ত্যাগ করে ‘রায়’ পদবী গ্রহণ করেন শোলাঙ্কিরা। এঁদের একটি শাখা ডেবরা থানার গড়কিলা পৌঁছায়। অন্য একটি শাখা জনৈক সাগররাম সিংহ (রায়)-এর নেতৃত্বে কংসাবতী নদীপথে মেদিনীপুর পৌঁছে যায়।
মেদিনীপুর শহরের দক্ষিণ অংশ সেটি। শহরে প্রবেশ না করে, নদীর কুলেই স্থিত হয়েছিলেন সাগররাম। শহরবাসীর কাছে নিজেদের পরিচয় গোপনের জন্য, আবার পদবী পরিবর্তন করে নিয়েছিল শোলাঙ্কি গোষ্ঠীটি। এবারে স্থানীয় মাহিষ্য সম্প্রদায়ের সাথে মিশে যেতে চাইলেন তাঁরা। নতুন পদবি হল– জানা। কয়েক শ’ বছর ধরে সেই জানা পদবীতেই পরিচিত হয়ে গিয়েছেন এই বংশটি।
নিজের প্রায় সমস্ত সম্পদ নিয়ে চলে এসেছিলেন সাগররাম। নতুন করে একটি জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন এখানে। প্রাসাদ তৈরির সাথে সাথে কুলদেবতার জন্য একটি মন্দিরও গড়েন তিনি। শোলাঙ্কিরা এসেছিলেন পশ্চিমের কৃষ্ণ-ভূমি থেকে। কৃষ্ণ কেবল তাঁদের আরাধ্য দেবতা নন, তিনি আদরের দেবতাও। এদিকে বাংলায় তখন চৈতন্য প্রভাবে বৈষ্ণবীয় রীতিতে ধর্মচর্চার প্লাবন চলেছে।
কেবল মেদিনীপুর শহর নয়, সারা জেলা জুড়েই তখন চৈতন্যদেব এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের গভীর প্রভাব। রাজা-জমিদার-সাধারণ প্রজাবর্গ– সকলেই বৈষ্ণবীয় রীতিতে দেবারাধনা করছেন। জানা পরিবারও সেই পথের পথিক হন। কৃষ্ণকেই কুলদেবতা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন সাগররাম। দেবতার নাম করেছিলেন– রাধাবল্লভ জীউ। ইং ১৮০৬ সালে জানা পরিবার রাধাবল্লভের জন্য এই নব-রত্ন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করে।
পৌনে ১৯ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের বর্গাকার মন্দির। উচ্চতা ৪২ ফুট। পূর্বমুখী মন্দিরের চারদিকে চারটি অলিন্দ। প্রতিটিতেই তিনটি করে খিলান রীতির দ্বারপথ। অলিন্দগুলি পরস্পর যুক্ত। সেকারণে, প্রদক্ষিণ-পথ হিসাবেও কাজ করে সেটি।
গর্ভগৃহের ভিতর থেকে ত্রিতল পর্যন্ত সিঁড়ি রচিত আছে। দ্বিতলে পুর্ব-উত্তর-দক্ষিণ দিক জুড়ে অলিন্দ। পশ্চিমে অলিন্দ নাই, তার বাইরের দেওয়ালে তিনটি প্রতিকৃতি দ্বার দেখা যায়। দুটি তলের মাথাতেই চালা-রীতির গড়ানো ছাউনি। কার্নিশের বঙ্কিম ভাবটি বেশ মনোরম হয়েছে।
রত্নগুলি গড়া হয়েছে কলিঙ্গধারায়। বাঢ় এবং গন্ডী অংশ জুড়ে ‘রথ-বিভাজন’ এবং গন্ডী অংশে পীঢ় বা থাক ভাগ করা। দেখলে, রত্নগুলিকে এক একটি শিখর দেউল মন্দির বলে মনে হয়। কোণের আটটি রত্নে ত্রি-রথ এবং কেন্দ্রীয় রত্নে পঞ্চ-রথ ভাগ করা হয়েছে। রত্নগুলির শীর্ষক অংশে বেঁকি, আমলক, ঘন্টা, কলস, বিষ্ণুচক্র শোভিত। এক কথায়, রাধাবল্লভের এই মন্দির ভারী সুদর্শন।
মন্দিরের সামনে ছোট একটি অঙ্গণ ছিল। তাতে সম্প্রতি নাটমন্দির (দ্বিতলে কয়েকটি কক্ষ সহ) হিসাবে বড় আকারের একটি সিমেন্টের কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। প্রথমেই মনে হয়, যেন উপলক্ষ (নাটমন্দির) আসল বস্তুকে (মূল মন্দির) ছাড়িয়ে গিয়েছে। আড়ালে চলে গিয়েছে দেব-সৌধটি। যেন, দেবতার বিগ্রহ চাপা পড়ে গিয়েছে ঢাকের তলায়।
মেদিনীপুর শহরের একটি বিখ্যাত বনেদী পরিবার জানাবংশ। এক সময় শহরে বিশেষ খ্যাতি ছিল জানাবাড়ির রাস উৎসবের। মন্দিরকে নিয়ে অনেকখানি জায়গা জুড়ে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা প্রশস্ত প্রাঙ্গণ আছে। প্রাঙ্গণের ভিতর একটি রাসমঞ্চও নির্মিত হয়েছিল দেবতার জন্য। বহুকাল সেটি পরিত্যক্ত, জীর্ণ। ঝোপঝাড় লতাগুল্মে ঢাকা হয়ে মৃত্যুর দিন গুনছে রাসমঞ্চটি।
জমিদারী উচ্ছেদ এবং শরিকী ভাগ-বাঁটোয়ারায়, দুর্দিনের সূচনা হয়েছিল মন্দিরের। পূজা-পার্বণে কাট-ছাঁট , মন্দির সংস্কারের কাজে সঙ্কট বিভিন্ন ভাবে ক্ষতি করেছে মন্দিরটির। জীর্ণতা বাসা বাঁধছিল সৌধটিতে। সেই পটভূমিকায়, নবদ্বীপের ‘ শ্রী চৈতন্য সারস্বত মঠ ‘ নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই মন্দিরের পরিচালনার ভার গ্রহণ করেছেন। নাটমন্দিরটি নির্মাণ করেছেন যেমন, তাঁরাই সংস্কারের কাজও করেছেন মন্দিরের। তাতে নবজীবন লাভ করেছে মন্দিরটি, স্বীকার করতে হয়।
কিন্তু …। একটা কিন্তু থেকে গিয়েছে, সংস্কার কাজকে ঘিরে। যাঁরা ঐতিহ্য এবং নন্দনশিল্পের প্রেমিক, সংস্কারকাজটি কিছু হতাশ করেছে তাঁদের। মন্দিরের সামনের দেওয়াল, এবং দক্ষিণের দেওয়ালে, অলংকরণের কিছু কাজ ছিল। সবই টেরাকোটা ফলক এবং পঙ্খের কাজ। ১. সংস্কারের সময়, জীর্ণ টেরাকোটা ফলকগুলি সরিয়ে, টেরাকোটারই কয়েকটি আধুনিক ফলক লাগানো হয়েছে। যা চোখে পীড়ারই উদ্রেক করে। ২. গর্ভগৃহের দ্বারপথের দু’পাশে পূর্ণাবয়ব দুটি গোস্বামী মূর্তি আছে। সেই দুটি সহ, মন্দিরের সমস্ত ফলকের উপর নির্বিচারে চুনের প্রলেপ লাগানো হয়েছে। তাতে টেরাকোটার সৌন্দর্য তো মুছেছেই, ফলকগুলির স্থায়িত্বকেও সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
মন্দিরের সংস্কার কাজটি পুরাপ্রেমীদের আশ্বস্ত করলেও, এই খেদটুকু মুছবার নয়।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী যোগেশ চন্দ্র জানা, মোহিত কুমার জানা, শৈলেন কুমার জানা, রণজিৎ কুমার জানা– জানাপাড়া, নজরগঞ্জ, মেদিনীপুর শহর।
সমীক্ষা সঙ্গী : শ্রী রবি দে, চিত্রশিল্পী– নজরগঞ্জ, মেদিনীপুর শহর।
যাওয়া-আসা : যে কোনো দিক থেকে মেদিনীপুর শহরে আসা যাবে। শহরের পাটনা বাজার-যুগিনীতলা বাসস্টপেজ থেকে সামান্য দক্ষিণে নজরগঞ্জ জানাপাড়ায় মন্দিরটি অবস্থিত।