Homeসাহিত্যরবিয়াণীআলোর পথযাত্রী

আলোর পথযাত্রী

✍️কলমে: বঙ্কিম বিহারী মাইতি

আই.আই.টি. খড়্গপুর এর প্রাক্তনী

দূর থেকে চেয়ে দেখি- ওরা যায় আসে, দলে দলে। ওরা ক্লান্তিহীন। ওদের বাড়ি নেই, স্বামী, স্ত্রী, পিতা মাতা, পুত্র, কন্যা, কেউ নেই। শুধু আছে- কর্তব্যের টান। হৃদয়েতে সেবামন্ত্র লেখা। তিরস্কার পুরস্কার ওদের বিচলিত করেনা। ওদের কাছে পুরস্কার- মৃত্যুকে পরাজিত করে জীবনকে জয়ী করা।
ওরাই অমৃতের সন্তান। অমৃত সন্ধান করাই ওদের লক্ষ্য। ডাক্তার, নার্স- যে নামেই ওদের ডাকো, ওরাই প্রকৃত দেব দেবী। অন্য সমস্ত দেবদেবী- যাদের আমরা পূজা করি- তাদের মধ্যে কেউ রাগী, কেউ দয়ালু, কেউ প্রতিহিংসা পরায়ণ, কেউ ক্ষমতালোভী- সবাই লুকিয়ে গেছেন। তাঁদের মহিমা ওই পূরাণের পাতাগুলোতেই বন্দী হয়ে থাকুক।

এখন ‘এক পৃথিবী’ বিজ্ঞান আসুক মানুষের জন্য। ‘এক পৃথিবী’ ভালোবাসা আসুক মানুষের জন্য। এক পৃথিবী ধর্ম আসুক মানবতা নিয়ে।
গুহাবাসী মানুষ গুহা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে অনেকদিন আগে। সভ্যতার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ক্রমে সে শিখরের কাছে চলেছে। কিন্তু মানুষের মনে আদিম প্রবৃতিগুলো এখনও লুপ্ত হয়ে যায়নি। বরং যুগে যুগে মাঝে মাঝেই তা ভয়ঙ্কর ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের শোক-তাপ রোগ ভোগের বিরুদ্ধে মানুষ যতনা যুদ্ধ করেছে- তার চেয়ে অনেক বেশি যুদ্ধ করেছে বেঁচে থাকার বিরুদ্ধে।

আর যুদ্ধের মহিমা কীর্তন করার জন্য কখনও নাম দিয়েছে ধৰ্মযুদ্ধ, কখনও বা ন্যায়যুদ্ধ। কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু যুদ্ধক্ষেত্রে চিহ্নিত হয়েছে- বীরের মৃত্যু, পুণ্য মৃত্যু হিসাবে।
যুগে যুগে সুবিধাভোগী সমাজপতিরা পরম বিচক্ষণতার ভাব মুখে এনে সরল সাধারণ মানুষকে বুঝিয়েছে পৃথিবীতে যত যুদ্ধ ঘটেছে – সব ভূমি এবং নারীর জন্য।
-ইতিহাস, তুমি হাততালি দাও!
শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত শিরোমণিরা পরম বিজ্ঞতার ভাব মুখে এনে মাথা নেড়ে বলেছিলেন- নারী হল নরকের কীট!
-শাস্ত্র তুমি হাততালি দাও!
কিন্তু মানবতার পথিক, আলোর দিশারী লোহার কাঠামোয় তৈরী কিছু মানুষ যুদ্ধের বীভৎসতা, আর্তনাদ, রক্তস্রোতের মাঝেও কর্তব্যে অবিচল।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধভূমে, আর্ত সৈনিকেরা দেখতে পায় আলোক হাতে এক মাতৃমূর্তি – তিনি দয়াময়ী ফ্লোরেন্স – নাইটিঙ্গেল। পীড়িতের সেবায় ক্লান্তিহীন। ক্ষতস্থানে যেন মায়ের স্নেহ পরশ।
মনরে, চেয়ে দ্যাখ – ধূসর ইতিহাসের পাতা ছুঁয়ে – ওই যে চলেছেন ‘চরক’ – আর্তের সেবায় ক্লান্তিহীন। চারণ করে করে রোগগ্রস্ত মানুষের কাছে গিয়ে সেবা করতেন – তাই নাম হয়েছিল ‘চরক’।

যুদ্ধের উন্মাদনা মানুষকে অন্ধ করে তোলে – বিবেকবুদ্ধি বিচার ক্ষমতা সব হারিয়ে যায়।
মাটির উপর আঁক কষে চলেছেন – মহাবিজ্ঞানী আর্কিমিডিস। জটিল অংকের সমাধান খুঁজতে ব্যস্ত। হঠাৎই সামনে এসে দাঁড়াল এক উদ্ধত রোমান সৈনিক। রুক্ষ কণ্ঠে পরিচয় জানতে চাইল। আত্মমগ্ন বিজ্ঞানী শুনতেই পেলেননা সেকথা। অপমানিত ক্রুদ্ধ সৈনিকের তরবারি আঘাত হানলো বিজ্ঞানীর গায়ে। তবু আর্কিমিডিস স্থির দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন- ‘আমাকে হত্যা করতে পারো, কিন্তু আমার বৃত্তকে মুছে দিতে পারবেনা’।
মুহূর্তে তরবারির চরম আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ছিন্ন মাথা।
মৃত্যু হলো বিজ্ঞানীর – মৃত্যু হলোনা বিজ্ঞানের।
কিন্তু কি আশ্চর্য – মানুষের হিংসা যখন রক্ত ঝরিয়েছে মানুষের চৈতন্যে – প্রতিদানে শুনেছে, – ‘মেরেছো কলসির কানা , তাই বলে কি প্রেম দেব না?
মানুষের অহংকার যখন ক্রুশবিদ্ধ করেছে মানবতাকে – প্রতিদানে শুনেছে – ‘ঈশ্বর, এদের ক্ষমা করো, এরা জানেনা এরা কী করছে।’ হায় যুদ্ধবাজ অহংকারী মানুষ- আজ বিধ্বস্ত কেন ছোট এক ভাইরাস করোনার সঙ্গে মহাযুদ্ধে। এখানে তো ধর্ম প্রতিষ্ঠার কারণে- ন্যায় প্রতিষ্ঠা কারণে – ভূমি এবং নারীর কারণে যুদ্ধের তত্ব খাটে না।
করোনা ভাইরাস আজ-কাল্পনিক দেবতা আর অন্ধ কুসংকার নিয়ে যুগ যুগ ধরে বয়ে চলা চেতনায় কুড়ুল মেরে ভেঙে দিয়েছে,- বিশ্বজুড়ে ক্ষমতা যুদ্ধ, বাকযুদ্ধ ধৰ্ম যুদ্ধ – সব যুদ্ধকে ঠান্ডা করে দিয়েছে। কামান, বিমান, অনু, পরমাণু কোনো অস্ত্রের দরকার নেই। এই ভাইরাস একাই গোটা মানব জাতিকে ধ্বংস করতে পারে।

দেশে দেশে রাষ্ট্রনেতারা কোটি কোটি নিরম্ন মানুষের মুখের গ্রাসের পরিবর্তে যে মারণাস্ত্র সম্ভার গড়ে তুলেছেন- তার ক্ষমতা ম্লান হয়ে গেল এই অদৃশ্য বীজাণুর কাছে।
তাই মূল্যহীন এই মারণাস্ত্র ভান্ডারের পরিবর্তে রাষ্ট্র ফিরিয়ে দিক শিশুর মুখে হাসি, নিরন্নের মুখে অন্ন, গৃহহীনের গৃহ, অসুস্থের আরোগ্য নিকেতন।
তাহলে সমগ্র পৃথিবী হয়ে উঠবে এক ফুলের বাগান। মানুষ মানুষের দিকে ছুড়ে দেবে অস্ত্র নয়, ফুল।
ব্রুনো, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিওকে শেষ করা গেলেও বিজ্ঞানকে শেষ করা যায় না। চির সত্য এই যে – পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে।
আলোর পথযাত্রীরা হেঁটে চলেছেন উদয়ের পথে। ওরা ক্লান্তিহীন। জীবনের জন্য সঞ্জীবনী এক চেনা আলো ওরা চয়ন করে আনবেই।
আলোকিত হবে মুমূর্ষু বিশ্ব।

RELATED ARTICLES

Most Popular