✍️কলমে: ভাস্করব্রত পতি
“শ্রাবণের পুরো, ভাদ্রের বারো, এর মধ্যে যত পারো”– অর্থাৎ গোটা শ্রাবণ মাস এবং ভাদ্র মাসের প্রথম বারোদিন পর্যন্ত যত পারো ধানের চারা রোপন করতে হবে। কেননা, এই সময়ই ধানের চারা রোপণের প্রকৃত সময়। লোককৃষির এহেন কথা বাংলার চাষিরা জানে। এবং মেনেও চলে।
ভাদ্র মাস শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে চাষের কাজও শুরুর করে দিয়েছে সকলেই। সবসময়ই বাঙালি চাষিকূল আসলে মেনে চলে চিরকালীন কিছু রীতি এবং নিয়মকানুন। জীবনের অভিজ্ঞতা আর বংশানুক্রমিক কিছু রীতিনীতি তাঁদের চাষজীবনের অঙ্গ। খনার বচনেও চাষাবাদ নিয়ে নানা আদব কায়দার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চাষিদের কাছে সেগুলো সত্যিকারেরই অন্যতম পালনীয় আদেশের মতোই। ভরসার অন্যতম আকর।
‘খনা’ শব্দের প্রকৃত অর্থ ‘ক্ষণ’। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়। কৃষিকাজ থেকে আবহাওয়া গণনার মূলে এই ক্ষণ বা সময়। অনেকের মতে ‘খনার বচন’ অর্থে জ্ঞানীর বচন বোঝানো হয়েছে। মূল তিব্বতী শব্দ ‘মখন’ এর অর্থ হোলো জ্ঞানী। তাহলে বলা যেতেই পারে সেকালে বহু জ্ঞানীগুণী মানুষের সম্মিলিত চিন্তাভাবনা ও গবেষণা লব্ধ জ্ঞানের সার্বিক মূল্যায়ন হোলো ‘খনার বচন’।
খনা নামে এক বিদুষী নারীর কথা অনেকেই বলেন। তাঁর শুভক্ষণে জন্ম হয়েছিল বলেই নাম হয়েছে ‘ক্ষণা’ বা ‘খনা’। কেউ কেউ বলেন খনা হলেন মানবরাজ কন্যা। কেউ বলেন তিনি ময়দানবের কন্যা। আবার অনেকে উল্লেখ করেছেন সম্ভবত নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে বারাসতের দেউলি গ্রামে খনার জন্ম। আরো দ্বিমত রয়েছে খনার জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে। বাংলা অসম সীমান্ত এলাকার প্রাগজ্যোতিষপুরে এই খনার জন্ম এবং এর আসল নাম ‘লীলাবতী’। তবে, সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হোলো – খনার জন্ম আজ থেকে এক হাজার বছর আগে সিংহল তথা বর্তমান শ্রীলঙ্কার রাজা উপতিষ্যর কন্যা হিসেবে।
“খনা বলে শুন কৃষকগণ / হাল লয়ে মাঠে যাবে যখন / শুভক্ষন দেখে করিবে যাত্রা / পথে যেন না হয় অশুভ বার্তা / আগে গিয়ে করো দিক নিরূপণ / পূর্বদিক হতে কর হল চালন / তাহা হলে তোর সমস্ত আশয় / হইবে সফল নাহিক সংশয়”। অর্থাৎ নববর্ষের শুভক্ষণ দেখে চাষ শুরু করতে হয়। কোনোরকম অশুভ দর্শন এক্ষেত্রে ক্ষতিকর হতে পারে। তখন ফিরে আসা উচিত। আর মাঠের পূর্ব দিক থেকে হাল করা উচিত । তবেই কৃষিতে সাফল্য আসবে। চাষিরা এই বচন মেনে চলেন আজও।
“যদি হয় চৈতে বৃষ্টি / তবে হয় ধানের সৃষ্টি”। এবছর চৈত্র মাসে বৃষ্টি হয়েছে। স্বভাবতই ধানের ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু ধান কাটার মুহূর্তে তথা বৈশাখের শুরুতে ভালো রকম ঝড় বৃষ্টি চাষিদের মাথায় হাত ফেলে দিয়েছিল। যদিও খনার বচনে এই বৃষ্টির একটা ভালো দিক উল্লেখ করা হয়েছে- “বৈশাখের প্রথম জলে / আউশ ধান দ্বিগুণ ফলে”। এবছর বেশিরভাগ দিনেই দেখা গিয়েছে দিনের বেলায় রোদের প্রকোপ আর রাতের বেলায় বৃষ্টির ছোঁয়া। ছড়ানুসারে এর ফলে নাকি ধানের চারা দ্রুত বড় হয়। ছড়াটি এরকম “দিনে রোদ রেতে জল / দিন দিন বাড়ে ধানের বল”।
চাষিদের কাছে অজানা নয় “কোল পাতলা ডাগর গুছি / লক্ষ্মী বলেন ওইখানে আছি”। অর্থাৎ ফাঁক ফাঁক করে মোটা মোটা গুছি করে রোপন করলে ধান বেশি পরিমাণে উৎপন্ন হয়। আরেকটি বচনে আছে “থোড় তিরিশে ফুলো বিশে / ঘোড়া মুখো তেরো দিন / গুজগে ট্যাঁকে বুঝে রেখে / যা দিগে যার আছে হীন”। এতে এটাই বোঝানো হয়েছে যে ধানের থোড় আসার তিরিশ দিন পরে, ‘ফুলো বিশে’ অর্থাৎ শীষ জন্মালে তার কুড়ি দিন পরে ‘ঘোড়া মুখো’ হলে অর্থাৎ শীষের ভারে ঘোড়ার মতো বাঁকা মুখ হলে তার তেরো দিন পরেই ধান কেটে নেওয়ার আদর্শ সময়। চাষিরা অবস্থা বুঝে এক দুদিন আগে পরে কেটে নেয় সুবিধা মতো। এবারেও অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে ভুল করেনি চাষিরা। তেমনি ধানের শিষ এলে কি করতে হয় তাও জানে চাষি। “শিষ দেখে বিশ দিন / কাটতে মাড়তে দশ দিন”। অর্থাৎ যে ধান গাছে শিষ দেখা দেবে, তার দশ দিন পরে কেটে নেওয়ার উপযুক্ত হয়ে ওঠে। আর মাড়াইয়ের জন্য দশ দিন এবং তারপর ধানের গোলায় তোলা যায়।
খনা লিখেছেন “চৈতে থরথর / বৈশাখে ঝড় পাথর / জৈষ্ঠ্যে তারা ফুটে / তবে জানবে বর্ষা বটে”। এবছর তো সেরকমই পরিবেশ পেয়েছেন চাষিরা। ফলে চলতি বর্ষায় যে লাগাতর বৃষ্টির সম্ভাবনা তা নিশ্চিত। চাষের পক্ষে তো উপযুক্তই বটে। আবারও পাই, “আষাঢ়ে কাড়ান নামকে / শ্রাবণে কাড়ান ধানকে / ভাদরে কাড়ান শিষকে / আশ্বিনে কাড়ান কিসকে”। অর্থাৎ আষাঢ় মাসে রোয়া ধানের চারা রোপণের জন্য বৃষ্টি দরকার। শ্রাবণে ধানগাছের বৃদ্ধির জন্য দরকার বৃষ্টি। ভাদ্রমাসের বৃষ্টি ধানের শিষ আনতে সাহায্য করে। তবে আশ্বিন মাসে বৃষ্টির কোনো প্রয়োজন নেই। এসময় বৃষ্টি হলে ধান বা ফসলের খুব ক্ষতি হয়। কিন্তু এই নিয়ম মেনে এখন চাষের কাজ হয়না। পিছিয়ে গিয়েছে চাষের সময়।
কিন্তু কি হবে এবার? কোরোনা ভাইরাস উদ্ভুত লক ডাউনের কথা তো লেখা নেই খনার বচনে! তাই এমতবস্থায় কি করা উচিত, তা কেন উল্লেখ করলোনা কৃষি বিশেষজ্ঞ খনা? আদৌ কবে স্বাভাবিক হবে বর্তমান পরিস্থিতি? কিভাবে শেষ হবে বর্তমান চাষ?
বর্ষা তো এসেই গিয়েছে। মাঠ জুড়ে ব্যস্ততা চাষিদের। অথচ অন্যান্য উপার্জন বন্ধ। ট্যাঁকশূন্য। বীজ কেনা, জমিতে হাল করা, সার কেনা, মজুরের মজুরি দেওয়া — সব কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু টাকা? কোথা থেকে জুটবে? দিন দিন বাড়ছে সারের দাম। উৎপাদন খরচ বাড়ছে। অথচ চাষিরা উৎপাদিত ফসলের সঠিক দাম পাচ্ছে না। লবেজান অবস্থা। সরকার হাত গুটিয়ে বসে আছে। ফড়ে ও দালালদের রমরমা ব্যবসা চারদিকে। বাংলার কৃষক সমাজ এখন সত্যিই খুব সমস্যার বেড়াজালে আবদ্ধ।
এরকম চূড়ান্ত কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছেন আপামর কৃষককূল। ক্লান্ত অবসন্ন আর যন্ত্রনাক্লীষ্ট চাষিরা আজ জমির আলে বসে শুধু ভাবছেন খনার বচনের সেই ছড়াটি – ‘জানিবে হয় যদি মস্তক স্পন্দন / অবশ্যই প্রাপ্য তার অমূল্য ধন’। অর্থাৎ মাথায় কম্পন অনুভূত হলে অমূল্য ধন প্রাপ্তির প্রভূত সম্ভাবনা!