নরেশ জানা : কে.সি নাগের তৈলাক্ত বাঁশে বাঁদরের ওঠা নামার অঙ্ক শিখে যে বাঙালি বড় হয়েছে সে বাঙালি তো বটেই, নামটা শুনে হোঁচট খাচ্ছে সারা দুনিয়াই। অঙ্কটা মনে করুন, চপচপে তেল মাখানো বাঁশে বাঁদরটা তিন মিটার উঠেই হড়কে পড়ে যাচ্ছে দুমিটার! যে সময়ের ব্যবধানে বাঁদরটার এই ওঠা নামা সেই সময়ের হিসাবে তিরিশ মিটার বাঁশের ডগায় উঠতে বাঁদরটার কত সময় লাগবে? উত্তর একটা আছে কিন্তু এখন যে পাল্টা প্রশ্নটা আইআইটি খড়গপুর তুলে দিয়েছে তা’হল বাঁশটায় যে তেল মাখানো হবে তা কী তেলতেলে হবে নাকি পাউডার মাখানো মসৃন? মানে, বাঁশে তরল তেল মাখানো না কী তেলের পাউডার বা গুঁড়ো মাখানো?
হ্যাঁ, ঘটনা এটাই যে মিল্ক পাউডার বা গুঁড়ো দুধের মতই অয়েল পাউডার বা গুঁড়ো তেল বানানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেছেন আইআইটি খড়গপুর গবেষক অধ্যাপকরা আর এরফলে আমূল বদলে যাচ্ছে ফুড টেকনোলজি বা খাদ্য প্রযুক্তি শিল্পের দুনিয়া থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের রান্নাঘর। বলতে পারা যায় তেল চিটচিটে দিনের অবসান ঘটতে চলেছে আগামী দিনে।
এবার আর বোতলে বা তরল পাউচে নয়, তেল কিনে আনবেন গুঁড়ো দুধের কৌটা অথবা প্যাকেটের মত। বাড়িতে নিজের বয়ামে ঢালতে গিয়ে আর মেঝেতে উপচে পড়বেনা তেল! তেলের দুনিয়ায় এই বিপ্লবের নায়ক আইআইটি আইআইটি খড়গপুরের এগ্রিকালচার এন্ড ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক হরি নিবাস মিশ্র যাঁর নেতৃত্বে কাজ করছেন আরও দুজন গবেষক মৌসুমী ঘোষ ও মোনালিসা পট্টনায়ক। অধ্যাপক মিশ্র ‘দ্য খড়গপুর পোষ্ট’কে একটি একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন, “এই আবিষ্কারের প্রক্রিয়ায় তেলের পাউডার বা গুঁড়ো তৈরিটা যেমন প্রধান উল্লেখ যোগ্য তেমনই উল্লেখ যোগ্য হল এই ভোজ্য তেল হবে সস্তা, স্বাস্থ্য সম্মত, প্রকৃতি জাত আ্যন্টিঅক্সিডেন্ট, ভারসাম্য যুক্ত ফ্যাটি আ্যসিড সমৃদ্ধ।” অর্থাৎ, চাপ নেবেননা, হার্টের পেশেন্ট কিংবা মুটিয়ে যাওয়াদের কোনও চাপ থাকছেনা। এই তেলে তৈরি শুধু বাড়ির খাবার নয়, কেক পেস্টি চকলেট আইসক্রিমও এবার খেতে পারেন নির্দ্বিধায়।
কিন্ত কিভাবে তৈরি হবে তেলের গুঁড়ো? অধ্যাপক মিশ্র জানিয়েছেন, ” তেলের মধ্যে আমরা কিছু কঠিন যৌগ যুক্ত করে সেই কাথ্বটিকে মেশিনের বিশেষ স্প্রেয়ারের সাহায্য নিয়ে গুঁড়োতে পরিনত করব ঠিক যেভাবে তরল দুধকে গুঁড়ো দুধে পরিণত করা হয়।” এই ভোজ্য তেলকে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা সঞ্চিত স্থায়ী চর্বি মুক্ত করার জন্য এর সঙ্গে যুক্ত করা হবে মনোআনস্যাচুরেটেড এবং পলিআনস্যাচুরেটেড যৌগ। এরফলে শরীরের মধ্যে ঘি বা ডালডা, পাম অয়েল জাতীয় স্থায়ী চর্বি জমতে পারবেনা। অধ্যাপক মিশ্র বলছেন, “সারা বিশ্বজুড়েই ভোজ্য তেলের দুনিয়ায় এই ‘ পলি আন স্যাচুরেটেড ফ্যাটি আ্যসিড’ বা পিইউএফএ এখন জনপ্রিয় বা স্বাস্থ্য সম্মত প্রক্রিয়া যা কিনা হার্টের রোগি বা রক্তে কলস্টোরেল থাকা ব্যক্তিদের জন্য উপযোগী হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি এই তেলে যুক্ত করা হবে আ্যন্টিঅক্সিডেন্ট যৌগ যা শরীরের ভেতরে জমা হওয়া ক্ষতিকারক যৌগগুলিকে বের করে দিতে সাহায্য করবে।”
প্রাথমিক পর্যায়ে এই গুঁড়ো তেলের ব্যবহার হবে খাদ্য প্রক্রিয়া করন শিল্পে। চকলেট কেক পেস্টি আইসক্রিম থেকে শুরু করে হোটেলের নান, পরোটা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে এর ব্যবহার অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠবে বলেই গবেষকেরা আশা প্রকাশ করেছেন। গুঁড়ো বলেই প্যাকেজিং, পরিবহনে সুবিধা হবে এবং খোলা বাতাস না লাগলে বহুদিন অবধি একে রেখে দেওয়া যাবে যা সাধারন তেলের ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠেনা।
আইআইটি খড়গপুরের ডিরেক্টর অধ্যাপক বীরেন্দ্র তেওয়ারী আশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ” স্বাধীনতার সত্তর দশক পেরিয়েও আমাদের দেশের মানুষের জীবনযাত্রা এখনও পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের অভাব বোধ করছে এর কারন অজ্ঞতা ও অসচেতনতা। বর্তমানে সেই ধারার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই ধরনের স্বাস্থ্য সম্মত উপাদান যুক্ত ভোজ্য তেল যা সস্তাও বটে তা আমাদের গ্রামীন ও প্রান্তিক জীবনের মানুষের কাছে মহামূল্যবান স্বাস্থ্যকর উপাদান হিসেবে হাজির হবে।”
ইতিমধ্যেই এই প্রক্রিয়ার পেটেন্ট পেয়ে গিয়েছে আইআইটি এবং বাণিজ্যিক ভাবে বড় আকারে বাজারজাত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে বলেও আইআইটি জানিয়েছে। এই গবেষক গোষ্ঠী ইতিমধ্যেই বহু পুরষ্কার ও সম্মান লাভ করেছে যার মধ্যে ‘গান্ধিয়ান ইয়ং টেকনোলজিক্যাল ইনোভেশন আ্যওয়ার্ড-২০২০ উল্লেখযোগ্য।
সর্বশেষ , গৃহিণীদের উৎকন্ঠার অবসান ঘটিয়ে অধ্যাপক মিশ্র একটি টিপস দিয়েছেন, ” এই পাউডার বাজারে এলে তা ময়দা বা আটার সঙ্গে মিশিয়ে যেমন করে লেচি বানান বানিয়ে নিন। বেলে তাওয়ায় দিয়ে নাড়াচাড়া করুন। গরম হলেই তেল ছেড়ে বেরিয়ে আসবে আর এমনিই ভাজা হয়ে যাবে আর মুচমুচেও হবে। আলাদা করে ময়ান দিতেও হবেনা আর তেল দিতেও হবেনা।”