Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-- ৭৬

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৭৬

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল – ৭৬
রঘুনাথ মন্দির, মহিষদা (থানা– কেশপুর, মেদিনীপুর)
চিন্ময় দাশ

মেদিনীপুর পরগণা বা মহাল-এর জমিদারদের রাজধানী ছিল কর্ণগড়। কর্ণগড়ের শেষ রাজা অজিত সিংহ ছিলেন অপুত্রক। ইং ১৭৫৫ সালে অজিতের মৃত্যুতে, তাঁর দ্বিতীয় পত্নী রানি শিরোমণি জমিদারী পরিচালনা করতেন। ইং ১৭৯৩ সালে ভারতের বড়লাট লর্ড কর্নওয়ালিশ বাংলার পূর্বকালের জমিদারী ব্যবস্থার বিলোপ করে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রচলন করেন। তার ফলে, রাঢ় বাংলা জুড়ে ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’-এর সূচনা হয়। শিরোমণি সেই বিদ্রোহের সাথে যুক্ত– এই অভিযোগে ১৭৯৯ সালের ৬ এপ্রিল, ইংরেজরা রানিকে গ্রেপ্তার করে, ফোর্ট উইলিয়ামে নিয়ে যায়। রানি তাঁর শেষ বয়সে, একটি ‘হেবা নামা’ সম্পাদন করে, সম্পূর্ণ মেদিনীপুর জমিদারী নাড়াজোল রাজবংশের আনন্দলাল খানকে দান করে দিয়েছিলেন। সেদিন থেকে নাড়াজোল রাজবংশ নাড়াজোল এবং মেদিনীপুর দুটি জমিদারির অধীশ্বর হয়ে উঠেছিল।


আনন্দলালও অপুত্রক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর সহোদর ভাই মোহনলাল খাঁন জমিদার হয়েছিলেন। সেকালের ‘জ্যেষ্ঠাধিকার রীতি’তে, মোহনলালের জ্যেষ্ঠপুত্র অযোধ্যারাম যখন জমিদার, সেসময় শরিকী বিবাদে (সঠিক বললে, ভ্রাতৃবিবাদ) বহু মামলা-মোকদ্দমার সূত্রপাত হয়েছিল সম্পত্তির অধিকার নিয়ে। সেই সূত্রে আদালতে বহু কাগজপত্র পেশ করতে হয়েছিল। তা থেকে জানা যায়, নাড়াজোল এবং মেদিনীপুর দুই জমিদারির বিশাল এলাকা পরিচালনার জন্য বেশ কয়েকজন পত্তনিদার নিয়োগ করা হয়েছিল জমিদারের পক্ষ থেকে।
খড়গপুর মহলের বাবু শশিভূষণ রায়, ঢেকিয়া বাজার পরগণার বসন্তপুরের হৃদয়নাথ রাউত, চেতুয়া পরগণার সোনামুই-নন্দনপুরের গোবর্ধন হাজরা, ঐ পরগণার ব্রাহ্মণবসানের ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, কিংবা হরিরামপুরের রাজেন্দ্রনাথ জানা প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। সেই কাগজপত্রে মেদিনীপুর পরগণার (বর্তমান কেশপুর থানা) বাড় মহিষদা গ্রামের জনৈক কালীপদ ঘোষের নামও পাওয়া যায় পত্তনিদার হিসাবে।


প্রকৃত ঘটনা হল, কালীপদর পিতামহ কৃষ্ণপ্রসাদ ঘোষই ছিলেন এই বংশের প্রথম পত্তনিদার। ঘোষ বংশের জমিদারী প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর হাতেই। কৃষ্ণপ্রসাদের পুত্র (কালীপদ-র পিতা) ছিলেন উদয়চন্দ্র। বাস্তুর ভিতরে, বসতবাড়ির একেবারে লাগোয়া করে, তিনিই রঘুনাথের মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঘোষ বংশের হাতে তিন-তিনটি শিবমন্দির নির্মিত হয়েছিল। শীতলেশ্বর শিবের নামিত মন্দিরটি প্রজাবর্গের জন্য উৎসর্গ করে দেওয়া হয়েছিল। জোড়া-শিব নামে পরিচিত দুটি শিবমন্দির ছিল জমিদারবংশের আরাধনার জন্য। কিন্তু সেসময় বাংলা জোড়া মহাপ্রভু চৈতন্যদেব এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে, বিষ্ণুকেই আশ্রয় করেছিলেন জমিদাররা। কুলদেবতা হিসাবে ‘রঘুনাথ’ নামের শালগ্রাম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। উদয়চন্দ্রই রঘুনাথের জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করে দেন।


চক্রবর্তী পদবীর একটি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণবংশ মন্দিরে পৌরহিত্য করেন। একেবারে প্রথম দিন থেকেই তাঁরা এই কাজে যুক্ত আছেন। উদয়চন্দ্র বা কালিপদ ঘোষের বর্তমান উত্তরপুরুষগণই সেবাইত হিসাবে দেবতার সেবাপূজা এবং মন্দিরটির ধারক-বাহক। কিন্তু জমিদারী উচ্ছেদ এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনে, ঘোষবংশের ভারী সংকটজনক অবস্থা। দেবতার সেবাপূজাই ঠিকমত ধরে রাখা যায়নি। মন্দির রক্ষার কাজ তাঁদের পক্ষে সুদূরের স্বপ্ন।


মন্দিরের সামনে দাঁড়ালে, প্রথমেই চোখে পড়ে কালো পাথরে খোদাই করা প্রতিষ্ঠা-লিপিটি। ফলকটি ডিম্বাকার। তার বয়ানটি এরকম– ” শ্রীশ্রী রঘুনাথজীউর / পঞ্চরতন সন ১৩০০ সালে / কার্ত্তিক মাহা হইতে আরম্ভ / সন ১৩০৪ সালের পৌষ মাহায় / সমাপ্ত সেঃ শ্রী উদয় চন্দ্র ঘোষ / সাং বাড় মহিষদা ” । অর্থাৎ ঠিক সোয়া একশ’ বছর আগে, বাড় মহিষদা গ্রামের অধিবাসী জনৈক উদয় চন্দ্র ঘোষ, এই পঞ্চ-রত্ন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ইটের তৈরী পূর্বমুখী পঞ্চ-রত্ন মন্দিরটির পাদপীঠ এখনও অনেকটা উঁচু। কিন্তু কোনও প্রদক্ষিণ-পথ নাই মন্দিরকে বেষ্টন করে। তবে সামনে কিছু প্রশস্ত পরিসর রাখা হয়েছে, ভক্তজনের সমাবেশের জন্য।


সামনে অলিন্দ আর পিছনে গর্ভগৃহ নিয়ে এই সৌধ। গর্ভগৃহে একটি এবং অলিন্দে তিনটি দ্বারপথ। সবগুলি দ্বার খিলান-রীতির। দুই প্রান্তে দুটি গোলাকার স্তম্ভ দিয়ে অলিন্দের দ্বারপথগুলি রচিত হয়েছে। অলিন্দের ভিতরের ছাদ বা সিলিং হয়েছে দুটি অর্ধ-খিলানের সাহায্যে। মাথায় গম্বুজ স্থাপন করে গড়া হয়েছে গর্ভগৃহের সিলিং।
গর্ভগৃহের মাথায় চালা-রীতির ছাউনি। ছাউনির জোড়মুখগুলিতে বিষ্ণুপুরী-চাল-এর অনুকরণ দেখা যায়। কার্ণিশের বঙ্কিম ভাবটি সুন্দর। পাঁচটি রত্নেও চালা ছাউনি। তবে সেগুলির জোড়মুখ হস্তীপৃষ্ঠের মত উত্তল। পাঁচটি রত্নই উঁচু চতুস্কোণ বেদির উপর স্থাপিত। রত্নগুলিতে বাঢ় এবং গন্ডীর জোড়মুখ বা বরণ্ড অংশগুলি বেশ প্রকট করে নির্মিত। রত্নের ছাউনি বা গন্ডী এবং নিচের বাঢ়– দুটি অংশ জুড়ে কলিঙ্গধারায় রথ-বিভাজন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় বা মাথার বড় রত্নটিতে পঞ্চ-রথ এবং বাকি চারটিতে ত্রি-রথ বিভাজন করা। রত্নগুলির শীর্ষক অংশ বেঁকি, আমলক, কলস, চক্র দিয়ে সাজানো।


তেমন উল্লেখযোগ্য অলংকরণ নাই মন্দিরে। ১. টেরাকোটা ফলক কয়েকটি মাত্র। সেগুলি আছে কার্ণিশের নীচ বরাবর কয়েকটি সারি, এবং দুই কোণাচের গায়ে দুটি খাড়া সারিতে। তাও আবার কয়েকবার রঙের প্রলেপে নিজেদের উজ্বলতা হারিয়ে ফেলেছে। ২. সামনে তিনটি দ্বারপথের মাথায় তিনটি বড় প্রস্থে পঙ্খের কারুকাজ করা হয়েছে। সবই জ্যামিতিক প্যাটার্নের কাজ। ৩. হিন্দু দেবমন্দিরে টিয়াপাখির মূর্তি রচনা স্বাভাবিক ঘটনা। এখানেও দু’জোড়া টিয়া দেখা যায়। ৪. আর আছে দুটি ব্যাদিত বদন সিংহমূর্তি। মুখ্য দ্বারপথটির মাথার উপর ঠাঁই পেয়েছে সেগুলি।


কুলদেবতার উৎসবের জন্য একটি রাসমঞ্চ নির্মাণ করেছিলেন জমিদার। মন্দির থেকে সামান্য দূরে, দীঘির পাড়ে, জোড়া শিবমন্দিরের মাঝখানে সেটি নির্মিত হয়েছে। পঞ্চ-রত্ন রীতির এই মঞ্চ বেশ কিছু টেরাকোটা ফলক দিয়ে সাজানো। চারটি কার্নিশের নীচে এবং চারটি দ্বারপথের দু’দিকে খাড়া সারিতে ফলকগুলি লাগানো।
আয়ুষ্কাল তেমন কিছু নয়, কিন্তু অত্যাচার আর রক্ষণের অভাবে মন্দির এবং রাস-মঞ্চ দুটি সৌধই জীর্ণতার শিকার। সংস্কার বা সংরক্ষণের প্রয়াস নাই কোথাও।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী সুভাষ চন্দ্র ঘোষ (সেবাইত), শক্তিপদ চক্রবর্তী (প্রাক্তন শিক্ষক), গোবিন্দ চক্রবর্তী (পুরোহিত)– মহিষদা।

সমীক্ষা-সঙ্গী : সর্বশ্রী পার্থ দে– তমলুক, রাজকুমার দাস– কলকাতা।
যাওয়া – আসা : মেদিনীপুর জেলা শহর থেকে বাসযোগে কেশপুর। সেখান থেকে নাড়াজোল গামী পথে ৪ কিমি দূরে মহিষদা স্টপেজ। অথবা, পাঁশকুড়া স্টেশন বা মুম্বাই রোডের মেচগ্রাম থেকে ঘাটালমুখী পথের বকুলতলায় নেমে, বাম হাতে কেশপুর গামী পথে মহিষদা স্টপেজ। সেখান থেকে কয়েক পা হেঁটে গ্রামে ঢুকে ঘোষবাড়ি এবং তাঁদের মন্দিরগুলি।

RELATED ARTICLES

Most Popular