জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৬৭
লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, টেপরপাড়া (পটাশপুর থানা, মেদিনীপুর)
চিন্ময় দাশ
মন্দির নির্মাণে পুণ্যলাভ হয়। কিন্তু ‘দেবীপুরাণ’-এ বলা হয়েছে, জীর্ণ মন্দির সংস্কার করলে, পুণ্য লাভ হয় তার থেকেও শত গুণ বেশি। আজ এই জার্নালে এমন এক অতি জীর্ণ মন্দিরের বিবরণ, যা সংস্কারের অতীত হয়ে গিয়েছিল। পুরাতনটিকে ভেঙে, সম্পূর্ণ নতুন করে গড়ে নিতে হয়েছে দেবতার আবাসটিকে।
ইং ১৫১০ সাল। দন্ডী কেশব ভারতীর কাছে দীক্ষা নিয়েছেন চৈতন্যদেব। সন্ন্যাস গ্রহণের পর, ১৮ দিন রাঢ়দেশ, শান্তিপুর এবং আটিসারাতে অতিবাহিত করে, পুরী রওনা হয়েছিলেন জগন্নাথ দর্শনের অভিলাষে। আটিসারা থেকে এসে হাজির হন ছত্রপুর (বর্তমান ডায়মন্ড হারবার)।
সেসময় বাংলার নবাবের সাথে কলিঙ্গরাজ প্রতাপরুদ্র দেবের ভয়ানক বিবাদ। থমথমে অবস্থা। সতর্ক পাহারা চারিদিকে। অতি সন্তর্পণে, রাত্রিকালে নৌকাযোগে গঙ্গা আর রূপনারায়ণের স্রোত বেয়ে, ভোরবেলা তমলুকে এসে নামেন চৈতন্যদেব। সেদিন ফাল্গুনের পঞ্চমী তিথি। তমলুক নগরীর গৃহস্থের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করেছিলেন মহাপ্রভু। রাত্রিকালে নিশিকীর্তন করেছিলেন পার্ষদগণকে নিয়ে।
তমলুক থেকে পুণরায় জলপথ ধরে রওনা হন তিনি। ভ্যালেন্টিন বা বাউরি-র মানচিত্রে দেখা যায় না, তবে একটি সংকীর্ণ জলধারার ছবি দেখা যায় রেনেল সাহেবের মানচিত্রে। বলা হয়, এই জলপথে, তমলুক থেকে টেংরাখালি এসেছিলেন চৈতন্যদেব। সেখান থেকে কেলেঘাই নদীর উজানে পশ্চিমমুখে এগিয়ে পাথরঘাটা নামক জায়গায় গিয়ে নামেন।
পাথরঘাটায় ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের স্মৃতিধন্য কঙ্কেশ্বর (অজ্ঞাতবাসকালে যুধিষ্ঠিরের ছদ্মনাম– কঙ্ক) শিবমন্দিরে আরাধনা করেন। সেখান থেকে স্থলপথ ধরে পটাশপুর থানার উপর দিয়ে দাঁতন থানা হয়ে রেমুনা অভিমুখে রওনা হয়ে যান। মহাপ্রভুর যাত্রার অভিঘাতে পটাশপুর আর দাঁতন দুটি থানা প্রেমধর্মে প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল। রাজা-জমিদার থেকে সাধারণ প্রজাবর্গ এমন কেউ ছিলেন না, যে পরিবারে নতুন করে বৈষ্ণবীয় রীতিতে পূজার প্রচলন হয়নি। শুধু তাই নয়, বহু মঠ-মন্দিরও গড়ে উঠেছিল সেসময় থেকেই। এই দুটি থানার খাড়ান, টেপরপাড়া, ছাড়াদীঘি, পটাশপুর, নৈপুর, অমর্শি, সাউরী, হরিপুর ইত্যাদি গ্রামের মঠগুলি এখনও,, ৪০০-৫০০ বছর যাবৎ, পূর্ণ মহিমায় বিরাজমান আছে।
পাথরঘাটা থেকে তাঁর যাত্রাপথটি গিয়েছে টেপরপাড়া গ্রামের উপর দিয়েই। গ্রামের একটি পরিবার বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা এবং ‘দাস অধিকারী’ পদবী গ্রহণ করে। লক্ষ্মীজনার্দন নামিত শালগ্রাম প্রতিষ্ঠা করে, পূজারও প্রচলন করা হয়। পরিবারটির কুলপঞ্জীর হিসাবে সেটি ২১ পুরুষ আগের ঘটনা। অর্থাৎ মহাপ্রভুর অভিযাত্রার অব্যবহিত পরেপরেই এটি ঘটেছিল।
এই বংশের জনৈক বাঞ্ছারাম দাস ছিলেন প্রকৃতই সাধক পুরুষ। বহু শিষ্য ছিল তাঁর। উনিশ শতকের একেবারে গোড়ায়, বাঞ্ছারামই লক্ষ্মীজনার্দনের জন্য শিখর-রীতির একটি মন্দির গড়েছিলেন। ২০০ বছরে জীর্ণ হয়ে, সংস্কারের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল মন্দিরটি। সম্প্রতি বাঞ্ছারামের উত্তর পুরুষগণ পুরাতন মন্দির ভেঙে, নতুন একটি মন্দির গড়ে নিয়েছেন।
আদি এবং বর্তমান, পুরাতন এবং নতুন– দুটি মন্দিরেরই স্থাপত্যশৈলী আলোচনা করে নেব আমরা। যাতে পূর্বের মন্দিরটির কথা আমরা ভুলে না যাই, তাই সেটিরও বিবরণ টুকে রাখা হোল।
আদি মন্দির : উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে নির্মিত হয়েছিল মন্দিরটি। স্থাপত্যশৈলী থেকে এ কথা অনুমান করেছিলেন পুরাবিদরা। কোনও প্রতিষ্ঠা-লিপি ছিল না মন্দিরে। কলিঙ্গ-স্থাপত্যধারায় শিখর-রীতির মন্দির হিসাবে গড়া হয়েছিল। তিন অংশে বিন্যস্ত পূর্বমুখী দেবালয়। সামনে ‘চার-চালা’ রীতির জগমোহন। পিছনে শিখর-রীতির বিমান বা মূল মন্দির। আর, এই দুইয়ের মাঝখানে সংক্ষিপ্ত আকারের একটি অন্তরাল।
জগমোহনে চার দিকে চারটি দ্বারপথ। পশ্চিমেরটি অন্তরালের সাথে যুক্ত। অন্তরাল থেকে গর্ভগৃহে প্রবেশের একটিই দ্বার। সবগুলি দ্বারই খিলান-রীতির।
জগমোহনের ভিতরের ছাদ বা সিলিং গড়া হয়েছিল চারটি ‘অর্ধ-খিলান’এর সাহায্যে। আর, চার কোণে ক্ষুদ্রাকার চারটি খিলান গড়ে, তাদের মাথায় গম্বুজ রচনা করে গড়া হয়েছিল গর্ভগৃহের সিলিং। বিমানের দেওয়াল রথ-বিভাজন করে গড়া। সপ্ত-রথ বিভাজন হয়েছিল এখানে।
দুটি সৌধেই শীর্ষক অংশ সাজানো ছিল বেঁকি, আমলক, ঘন্টা, কলস আর বিষ্ণুচক্র দিয়ে। এটি সেবাইত বংশের বয়ান। ২০১০ সালে মন্দিরটি প্রথম সমীক্ষার সময় দেখতে পাইনি আমরা। তার পূর্বেই এগুলি বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
অলংকরণ হিসাবে টেরাকোটা ফলক দিয়ে সাজানো হয়েছিল মন্দিরটি। তার কিছু কিছু নিদর্শন ২০১০ সালেও অবশিষ্ট ছিল, আমরা দেখেছি। ফলক ছিল জগমোহনের সামনের দেওয়াল জুড়ে, তিনটি বড় প্রস্থে। কৃষ্ণকথাই ছিল প্রধান মোটিফ। এছাড়া ছিল বিষ্ণুর দশাবতার, মৃদঙ্গ-বাদক, মালাজপরত মোহন্ত মহারাজ ইত্যাদি।
বিমান অংশে ফলক সজ্জা করা হয়েছিল একটু বিশিষ্ট রীতিতে। বিমানের বাঢ় এবং গন্ডী অংশের সংযোজক হোল বরণ্ড। বিমানের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ– তিন দিকের দেওয়ালে রথগুলির বরণ্ডের উপর বড় আকারের (ফুট দেড়েক উচ্চতার) পৃথক পৃথক কিছু ফলক লাগানো ছিল। বৈষ্ণব, সংকীর্তন দৃশ্য, গৌর-নিতাই ইত্যাদি রূপায়িত হয়েছিল সেগুলিতে। তার সাথে ছিল কয়েকটি ‘মিথুন-ফলক’ও।
বর্তমান মন্দির : অত্যন্ত উঁচু পাদপীঠের উপর, অতি সম্প্রতি নির্মিত, শিখর রীতির পূর্বমুখী মন্দির। তবে, এটি গড়া হয়েছে ইট-সিমেন্ট-লোহা ব্যবহার করে। চার দিকের দেওয়াল জুড়ে অলংকরণ এবং রথ বিভাজন করা হয়েছে। মাথায় তিনটি আমলক, কলস, চক্র স্থাপিত। বহু মূর্তি সন্নিবেশ দেখা যায় মন্দিরে। সামনে একটি উন্মুক্ত নাটমঞ্চ। গর্ভগৃহে শালগ্রাম শিলার সাথে, রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ এবং গৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দের বড় আকারের দারু-বিগ্রহ পূজিত হয়।
সাক্ষাৎকার : ২০১০ সালে– সর্বশ্রী শ্রীবাস চন্দ্র দাস, কালীপদ দাস অধিকারী, শ্যামাপদ পাহাড়ী– টেপরপাড়া। অধ্যাপক চৌধুরী পিনাকী নন্দন দাস মহাপাত্র– শান্তিনিকেতন, বীরভূম।
২০১৭ সালে– সর্বশ্রী নারায়ণ চন্দ্র দাস অধিকারী, সুবল চন্দ্র দাস অধিকারী, গৌরহরি পণ্ডা (পুরোহিত)– টেপরপাড়া।
পুরাতন মন্দিরের ছবি : শ্রী অরিন্দম ভৌমিক, মিডনাপুর-ডট-ইন এর সৌজন্যে।
পথনির্দেশ : মেচেদা-দিঘা রাস্তার বাজকুল; এবং খড়্গপুর-কাঁথি রাস্তার এগরা। এই বাজকুল-এগরা পথের উপর টেপরপাড়া স্টপেজ। সেখান থেকে উত্তরমুখে পাথরঘাটা গামী পাকা রাস্তায় ১ কিমি দূরে মন্দিরটি অবস্থিত।