Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল - ৬২

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল – ৬২

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৬২
রঘুনাথ মন্দির, রাধাকান্তপুর (দাসপুর- ১, মেদিনীপুর জেলা)
চিন্ময় দাশ

বহু পূর্বকাল থেকে ঘাটাল মহকুমা কৃষিতে সমৃদ্ধ ছিল। রূপনারায়ণ, শিলাবতী, কংসাবতী ইত্যাদি নদীগুলির কারণে উর্বর কৃষিভূমি গঠিত হয়েছিল এই এলাকার। আর্থিক সমৃদ্ধি উন্নত হয়েছিল রাজা শোভা সিংহের সময়কালে। পথঘাটের উন্নতি, সেচ ও নিকাশীর উন্নতি, জলপথ সংস্কার, হস্তশিল্পের বিকাশের জন্য হাট-বাজার পত্তন ইত্যাদি বহু কাজ করেছিলেন শোভা।


শোভার উন্নয়নের কাজে যোগ্য সংগত করেছিলেন জনৈক বঙ্গরাম চৌধুরী। চেতুয়া পরগণায় (আজকের দাসপুর থানা) শোভারই একজন পত্তনীদার ছিলেন তিনি। তাঁর উদ্যোগে গ্রামীণ হস্তশিল্পের প্রভূত বিকাশ ঘটেছিল এক সময় । স্বর্ণবণিক, গন্ধবণিক, শোলাশিল্পী, তন্তুবায়, কুম্ভকার, কর্মকার, রেশমশিল্পী ইত্যাদির সাথে, শঙ্খশিল্পীরাও এই থানায় এসে বসতি গড়ে তুলেছিল। বৃত্তিকে কেন্দ্র করে পৃথক পৃথক পাড়া গড়ে উঠেছিল গ্রামে গ্রামে। রাধাকান্তপুর গ্রামের তেমনই একটি শাঁখারীপাড়া। সেখানে কোনোও একটি নন্দী পরিবার গৃহদেবতা রঘুনাথের জন্য একটি মন্দির গড়ে তুলেছিল।


এই নন্দী বংশ সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। একজনের নামই কেবল সংগ্রহ করতে পেরেছি আমরা। তিনি জনৈক যোগেন্দ্রনাথ নন্দী। তিনি ছিলেন বংশের শেষ পুরুষ, এবং বর্তমান আলোচ্য মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা। মন্দিরে জীর্ন একটি প্রতিষ্ঠালিপি আছে– ” শ্রীশ্রীরঘুনাথ জিউ /মন্দির সকাব্দ ১৭৬৮ /সক সন ১২৫৩ সাল “। অর্থাৎ পৌণে দু’শ বছর হয়েছে, ইং ১৮৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত, মন্দিরটির আয়ুষ্কাল।
নিঃসন্তান যোগেন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর, তাঁর পত্নী কিরণবালা দেবী তাঁর দুই ভ্রাতুষ্পুত্র তারাপদ দত্ত এবং অশ্বিনী দত্তের হাতে দেবতা এবং মন্দিরের ভার তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। চার পুরুষ ধরে দত্তরাই সেবাপূজা এবং মন্দিরের দেখভাল করেছেন। কিন্তু জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর, কোনও কিছুই আর টিকিয়ে রাখতে পারেনি পরিবারটি। কালে কালে দেবতা তুলে আনতে হয়েছে মন্দির থেকে। ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়েছে পরিত্যক্ত মন্দিরটি।
ইটের তৈরী দক্ষিণমুখী মন্দিরের গড়ন বর্গাকার। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১৬ ফুট হিসাবে, উচ্চতা আনু. ৩০ ফুট। মন্দিরটি পঞ্চ-রত্ন রীতির। ভিত্তিবেদীর চিহ্ন প্রায় নাই আর। ইমারতি রীতির অতি জীর্ণ স্তম্ভ আর দরুন রীতির খিলান সহ তিনটি দ্বারপথ আছে ভিতরে প্রবেশের। কিন্তু ভিতরের অংশটি ভারী দুর্গম। বিষধর সরীসৃপের বাসভূমি। অলিন্দের পিছনে ছোট মাপের গর্ভগৃহ। উঁকি দিলে শূন্য বেদীটি চোখে পড়বে।


পাঁচটি রত্নই শিখর-দেউল রীতিতে নির্মিত। উপরে চালা ছাউনি। পীঢ়-রীতির প্রয়োগ হয়নি। শিখরগুলির বাঢ় এবং গণ্ডী অংশ জুড়ে পঞ্চ-রত্ন বিভাজন করা হয়েছিল। একটি রত্নেও শীর্ষক অংশের কোনও চিহ্নই অবশিষ্ট নাই, সেগুলি সবই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, পরিত্যক্ত এই মন্দির মাটিতে মিশে যেতে বড় একটা বিলম্ব নাই। যা একদিন পরম আদরের দেবতার বাসভূমি ছিল, এখন সেটি ইঁদুর, ছুঁচো, মাকড়সা, বাদুড়, চামচিকে, বিষাক্ত সরীসৃপকূলের নিশ্চিন্ত আবাসভূমিতে পরিণত হয়েছে। লতা গুল্ম বৃক্ষ সকলেই দখল করে বসে আছে সৌধটিকে। জীবন ফিরে পাবার কোনও আশাই নাই এটির। আকারেও তেমন বড় নয় এই মন্দির। তবুও আমরা আলোচনার উপজীব্য করেছি এই মন্দিরকে। কারণ, এর টেরাকোটা ফলকের অলংকরণ।


টেরাকোটার বিন্যাস হয়েছে সামনের সম্পূর্ণ দেওয়ালটি জুড়ে। তিনটি দ্বারপথের মাথার উপরের তিনটি বড় প্রস্থে, কার্নিশের নীচ বরাবর সমান্তরাল দুটি সারিতে এবং দুই কোণাচের গায়ে দুটি খাড়া সারিতে। তিনটি বড় প্যানেলে কাহিনী নির্ভর বড় আকারের ফলক । কার্ণিশলগ্ন ২টি সারিতে ছোট ছোট ২২টি করে খোপে এবং খাড়া ২টি সারিতে ১২টি করে খোপে একক মূর্তি স্থাপিত হয়েছে।


মোটিফ বা বিষয়বস্তু অনুসারে, ফলকগুলিকে অনেকগুলি ভাগে ভাগ করা যায়– ১. রামায়ণ কাহিনী, ২. কৃষ্ণলীলা, ৩. চৈতন্যদেব, ৪. রাজসভা, ৫. দশাবতার, ৬. অন্যান্য দেবদেবী ইত্যাদি। ১. রামায়ণ কাহিনী থেকে আছে– জটায়ু কর্তৃক রাবণের রথ আক্রমণ, রাম-রাবণের যুদ্ধ, রাবণের সাথে হনুমানের যুদ্ধ, রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেক, রামচন্দ্রের রাজসভায় বিশ্বামিত্র মুনির আগমণ, সীতাদেবী সহ রাজা রামচন্দ্রের রাজসভা ইত্যাদি।
২. কৃষ্ণলীলা থেকেও অনেকগুলি বিষয় রূপায়িত হয়েছে– গোপিনীদের বস্ত্রহরণ, শ্রীকৃষ্ণের নৌকাবিলাস, শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা ইত্যাদি। তার ভিতর শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকাযাত্রার দৃশ্যটি ভারী মর্মস্পর্শী হয়ে ফুটে উঠেছিল ফলকে।
৩. চৈতন্যদেব মহাপ্রভুর ২টি ফলক আছে এই মন্দিরে– একটি তাঁর ছোট্ট মূর্তি। এবং অনিন্দ সুন্দর একটি ষড়ভূজ গৌরাঙ্গ মূর্তি। ৪. রাজসভার ফলকটিতে সিংহাসনে উপবিষ্ট কোনও এক রাজা এবং পিছনে চামরব্যজনরতা দাসী চিত্রিত হয়েছে। ৫. বিষ্ণুর দশাবতার রূপায়িত হয়েছে একক একক মূর্তিতে।

৬. অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তিগুলির ভিতর ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর মূর্তি তিনটি উল্লেখ করবার মত। পুরাবিদ অধ্যাপক প্রণব রায়-এর একটি মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। এই মন্দিরের টেরাকোটা সম্পর্কে বলেছিলেন– ” এসব কারুকার্য উচ্চমানের না হলেও, সুন্দর রেখাবিন্যাসের চমৎকারিত্ব আছে। ”
পরিতাপের কথা, শ্রীময়ী ফলকগুলির যৌবনকালের সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করবার সৌভাগ্য হয়নি আমাদের। রূপ বা সৌন্দর্যের লেশটুকুও আজ আর নাই মন্দিরের এই কঙ্কালটিতে।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী অনিল দত্ত, সরোজ দত্ত– রাধাকান্তপুর।
যাওয়া-আসা : পাঁশকুড়া রেলস্টেশন কিংবা মুম্বাই রোডের মেচগ্রাম থেকে ঘাটালগামী পথে টালিভাটা স্টপেজ। সেখান থেকে পূর্বমুখে সামান্য দূরত্বে রাধাকান্তপুর গ্রাম এবং দত্ত পরিবারের এই পরিত্যক্ত মন্দির।

RELATED ARTICLES

Most Popular