Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-- ৫১

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৫১

জীর্ণ দেউলের জার্নাল– ৫১
রামচন্দ্র মন্দির, চিরুলিয়া (এগরা- ২)
চিন্ময় দাশ

কলিঙ্গ নামটি প্রথম পাওয়া যায় পুরাণ-কথায়। ঋষি দীর্ঘতমা-র ঔরসে দানবরাজ বলি-র পত্নী সুদেষ্ণার গর্ভে ৫ জন পুত্রের জন্ম হয়েছিল– অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র এব সুহ্ম। কালক্রমে এই ৫ ভাইয়ের নামে ৫টি জাতিগোষ্ঠীর উদ্ভব এবং ৫টি রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়। অতীতের সেই দুই সহোদর ভাই বঙ্গ আর কলিঙ্গ, মান্য ইতিহাসে দুই প্রতিবেশী রাজ্য হিসাবে গড়ে উঠেছে।

আধুনিক ইতিহাসে দেখা যায়, দ্বাদশ শতকের প্রথম পর্বে কলিঙ্গের রাজা ছিলেন অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গদেব (১০৭৭ – ১১৫০)। আজকের মেদিনীপুর সহ বঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিমের বিস্তৃত এলাকা তাঁর শাসনে ছিল। সেই শাসন বহাল ছিল দীর্ঘ সাড়ে চারশ’ বছর। ত্রয়োদশ শতকের ৩য় অনঙ্গ ভীমদেব (শাসন ১২১১ -১২৩৯) হয়ে, ষোড়শ শতকের শেষ পর্বে মুকুন্দদেব হরিচরণ (শাসন ১৫৫৯- ১৫৬৮) পর্যন্ত। পরবর্তীকালের সুলতানী শাসন এবং ইংরেজ অধিকারের সময়েও, ইং ১৮০৩ সাল পর্যন্ত মেদিনীপুরের সিংহভাগ এলাকা ওডিশার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আমাদের আজকের জার্নালে উঠে এসেছে মেদিনীপুর জেলায় চালা-শৈলীর সবচেয়ে বড় মন্দিরটির কথা। এগরা থানার চিরুলিয়া গ্রামে জমিদার পাহাড়ি পরিবারের হাতে গড়ে উঠেছিল মন্দিরটি। তাই প্রথমে পাহাড়ি পরিবারের ইতিবৃত্তটি জেনে নেওয়াই সঙ্গত হবে।

দ্বাদশ শতকের সূচনা থেকে অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ সাত শ’ বছরে ওডিশার বহু সম্ভ্রান্ত ও বনেদি হিন্দু পরিবার মেদিনীপুর জেলায় চলে এসেছিল। এখনও এই জেলার দক্ষিণ এবং পশ্চিম এলাকায় এরকম বহু জমিদার এবং ভূস্বামী পরিবারের বসবাস আছে। সেই স্রোত ধারায় পাহাড়ী পদবীর একটি পরিবার চলে এসেছিল এগরাচৌর পরগণার মহেশপুর গ্রামে।


এই পরিবারের জনৈক নন্দকুমার পাহাড়ী ছিলেন বাসুদেবপুরের জমিদারবাড়ির দেওয়ান। নন্দকুমার নিজেও একটি জমিদারী প্রতিষ্ঠা করে, মহেশপুরের অদূরে কিসমত শীপুর পরগণার এই চিরুলিয়া গ্রামে উঠে আসেন। ৩০ বিঘার বাস্তু ঘিরে নিজের অট্টালিকা গড়েছিলেন। নন্দকুমার সেখানেই গড়েছিলেন বিশাল আকারের রামচন্দ্র মন্দিরটি।
চার-পাঁচটি শৈলীর দেবমন্দির আছে মেদিনীপুর জেলায়। দালান, শিখর, রত্ন এবং চালা। এগুলির সাথে দু-চারটি পীঢ় শৈলীর মন্দিরও দেখা যায়। এসবের ভিতর চালা-রীতির উদ্ভবও যেমন হয়েছে বাংলারই স্থপতিদের হাতে, তেমনই এই মন্দির সংখ্যাও সবার চেয়ে বেশি। জেলা জুড়ে কত যে চালা-মন্দির আছে, তা গুণে ওঠা দুরূহ।
চালা-মন্দিরের আবার কয়েকটি ভাগ– এক-চালা, দো-চালা, চার-চালা, আট-চালা, বারো-চালা। এক-চালা বা দো-চালা মন্দির প্রায় দেখাই যায় না।

তবে, দুটি দো-চালাকে জুড়ে, যে অপরূপ ‘জোড়-বাংলা মন্দির’ তৈরি হয়, তেমন ৭/৮টি মন্দির আছে জেলা জুড়ে।চার-চালা আর আট-চালা মন্দিরের সংখ্যাই বেশি। আর, বারো-চালা মন্দির? প্রায় দেখাই যায় না। গোটা জেলা পরিক্রমা সেরে, মাত্র ৩টি বারো-চালা মন্দিরের সন্ধান পেয়েছি আমরা। দুটি মন্দির আছে ঘাটাল থানায়– জলসরা আর নতুক জয়কৃষ্ণপুর গ্রামে। তৃতীয় মন্দিরটি আছে এগরা থানার এই চিরুলিয়া গ্রামে। সেটি নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।একেবারে রাজকীয় গড়ন পৌনে দু’শ বছরের এই সৌধটির। পাদপীঠ এখনও প্রায় ৪ ফুট উঁচু। তার উপর গর্ভগৃহকে বেষ্টন করা প্রশস্ত প্রদক্ষিণ-পথ রেখে, মন্দিরটি স্থাপিত। পূবমুখী মন্দিরটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ৩০ ফুট, উচ্চতা ৫০ ফুট। বিশালতায় এই জেলায় মহিষাদল রাজপরিবারের রামবাগের মন্দিরের ঠিক পরেপরেই এটির স্থান।

তবে, রামবাগের মন্দিরে নাটমন্ডপ নাই। এখানে ৩০ বাই ২০ ফুট মাপের বিশালাকার বারোদুয়ারী নাটমন্ডপ। তাতে ত্রি-রথ রীতির ১২টি স্তম্ভ, আর মাঝখানে একটি যজ্ঞকুন্ড।
মন্দিরের চার দিকেই পরস্পরের সাথে সংযুক্ত চারটি অলিন্দ। তাতে অলংকৃত থাম ও তিনটি করে খিলান-রীতির দ্বারপথ। গর্ভগৃহে দ্বারপথ একটিই। ৫০ ফুট উচ্চতার বিশাল মন্দির। মুন্সিয়ানা দেখা যায় এর ভিতরের ছাদ বা সিলিং নির্মাণে। এর অলিন্দগুলির সিলিং গড়া হয়েছে টানা-খিলান করে। গর্ভগৃহের সিলিংয়ে দেখা যায়, পর পর দুদিকে খিলান গড়ে, তার মাথায় গম্বুজ স্থাপন করা হয়েছে। মন্দিরের বাইরের চার দিকের দেওয়ালেই, পাদপীঠের উপর থেকে একেবারে ত্রিতল পর্যন্ত, শিখর দেউলের অনুসরণে ত্রি-রথ বিভাজন করা হয়েছে।
কেবল আকারেই বড় নয় এই মন্দির।

অলংকরণের কাজও কিছু আছে। টেরাকোটা, পঙ্খ আর দারুতক্ষণ– তিন রীতিরই কাজ দেখা যায়। মোটিফ হিসাবে মূলতঃ রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী আর কিছু দেবদেবীর মূর্তি রচিত হয়েছে। গর্ভগৃহের দ্বারপথের দুদিকে দুটি পূর্ণাবয়ব দ্বারীমূর্তি, টেরাকোটার। উত্তর ও দক্ষিণের অলিন্দে দ্বারপথগুলির দুই প্রান্তে দুটি করে ‘ভিনিশীয় রীতির প্রতিকৃতি দ্বার’ রচিত। সেগুলিতেও পূর্ণাবয়ব দ্বারবর্তিনী মূর্তি স্থাপিত আছে। পরিতাপের কথা, বারংবার বর্ণলেপন করে, সৌন্দর্য তো হারিয়েছেই, এমনকি ফলকগুলির টেরাকোটা পরিচয়টুকুও আর বেঁচে নাই।


দক্ষিণে বাইরের দেওয়ালে প্রথম কার্ণিশের নীচে পরস্পর মুখোমুখি দুটি সিংহমূর্তি রচিত আছে। এই কাজটি পঙ্খের। ময়ূর, ফুলকারি নকশা ইত্যাদি পঙ্খের আরও কাজ আছে।
দারু-তক্ষণের উন্নত মানের কাজ আছে গর্ভগৃহের কাঠের দুটি পাল্লায়। মুখ্যত দেবদেবীদের মূর্তি খোদাই হয়েছে। তবে কাজের উৎকর্ষতা চেয়ে দেখবার মত।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী রজত বরণ পাহাড়ী, কাজল বরণ পাহাড়ী, ডাঃ চন্দন পাহাড়ী– চিরুলিয়া।
সমীক্ষা-সঙ্গী : শ্রী স্নিগ্ধেন্দু দাস, সুব্রত দাস– আটবাটি।
যাওয়া-আসা : মেদিনীপু-কাঁথি রাস্তায় তাজপুর কিংবা সাতমাইল স্টপেজ। সেখান থেকে ৫ কিমি মোটরেবল রাস্তা পার হয়ে চিরুলিয়া গ্রাম এবং পাহাড়ীদের মন্দির।

RELATED ARTICLES

Most Popular