জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৪৪
রঘুনাথ মন্দির, মণিনাথপুর (নারায়ণগড় থানা)
চিন্ময় দাশ
ইছামতী, মেঘনা, গঙ্গা আর কীর্তিনাশা– এই চার নদীর বেষ্টনীতে বিক্রমপুরের অবস্থান। অদূরেই বাংলার পূর্বকালের রাজধানি ঢাকা নগরী। বিক্রমপুরের সমৃদ্ধি পাল রাজাদের সময়ে। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এখানেই জন্মেছিলেন। পালবংশ ছাড়াও, হরিবর্মা , শ্যামবর্মা, বল্লাল সেন এখানে রাজত্ব করেছেন।
‘দিগ্বিজয়প্রকাশ’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে– “বিদ্বজ্জনানাং বাসশ্চ বিক্রমপুর্যাঞ্চ ভূরিশ। পরতালভূমিপস্য তোষিস্থলং বিদুর্বুধা ।।” যার অর্থ, বিক্রমপুরে বহু বিদ্বজ্জনের বাস। এই স্থানটি পরতালরাজের প্রমোদস্থান বলে খ্যাত।
এহেন বিক্রমপুর পরগণায় দেব-দ্বিজ-জমিদারী নিয়ে বাস করত দেব পদবীর একটি পরিবার। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশ বিষিয়ে তোলা হল একবার। হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি উধাও হয়ে গেল। স্বধর্ম রক্ষাই দায় হয়ে উঠল দিন দিন। দেব পরিবারে কর্তা তখন রঘুনাথ দেব। পরিবার-পরিজন আর সাধ্যমত অর্থ নিয়ে, চিরকালের জন্য ভিটেমাটি ছেড়ে চলে এলেন গঙ্গার এপারে। চার নদীর জলে মিশে রইল রঘুনাথ দেবের বেদনার অশ্রু।
পূর্বের দেশ থেকে রওনা হয়ে, একেবারে পশ্চিমে এসে থেমেছিলেন রঘুনাথ। আর ক্রোশ কয়েক দূরে ওডিশা রাজ্য। প্রাচীন ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোডের পাশে মণিনাথপুর গ্রাম। থিতু হয়ে বসলেন সেখানে। দূরদর্শী ছিলেন মানুষটি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের সুবাদে একটি জমিদারী প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন নতুন ভূমিতে।
রঘুনাথের তৃতীয় পুরুষে পৌঁছে জমিদারি যেমন বাড়ল , খ্যাতিও বাড়ল তেমনই। ইংরেজ সরকার থেকে ‘চৌধুরী’ খেতাব পেলেন জমিদারবংশ। কৌলিক ‘দেব’ পদবীর সাথে, সেদিন থেকে নতুন ‘চৌধুরী’ পদবী যোগ হল।
এর পরের তৃতীয় পুরুষে জমিদার ছিলেন রামচরণ দেব চৌধুরী। তাঁর সময়ে জমিদারীর আয়তন বহু পরিমান বেড়ে যায়। পাশেই অভিশপ্ত বলরামপুর জমিদারী। অপুত্রক জমিদার বীরপ্রসাদ মারা গেলে, তাঁর ৩য় পত্নী অনঙ্গমঞ্জরীর প্রাপ্য অংশ, পিতৃবংশ হিসাবে রামচরণের অধিকারে আসে।
রামচরণের পিতা ছিলেন স্বনামধন্য জমিদার প্রেমচাঁদ দেব চৌধুরী। খড়্গপুর শহরের হিজলীর প্রেমবাজার তাঁর নামেই গড়ে তোলা। এই দেব চৌধুরীদের খাস হওয়া সম্পত্তির উপর, হিজলীতে আই.আই.টি. গড়ে তুলেছিলেন বিধান চন্দ্র রায়।
যাইহোক, দেব পরিবারের কুলদেবতা ছিলেন রঘুনাথ নামের শালগ্রাম শিলা।
বিক্রমপুর ছেড়ে আসবার সময়, দেবতাকে বুকে আগলে নিয়ে এসেছিলেন রঘুনাথ দেব। পরিবারে রেখেই পূজার প্রচলন করেছিলেন। রামচরণ জমিদার হয়ে, রঘুনাথের জন্য মন্দির নির্মাণ করেন মনিনাথপুরে। সময় তখন ইং ১৯২৫ সাল।
মজবুত প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ইটের তৈরি পূর্বমুখী মন্দিরটি, যেন ছোট আকারের একটি ফোর্ট টেম্পল। রাজকীয় গড়নের ফটক।
পশ্চিম দেওয়ালের সাথে পাকশাল, ভাঁড়ারঘর। মন্দিরের উঁচু পাদপীঠে চতুস্কোণ প্যানেল ভাগ করে অলংকরণ করা। পাদপীঠের দৈর্ঘ্য ২৬ ফুট, প্রস্থ সাড়ে ২০ ফুট। শিখর-দেউল রীতির মন্দির। দৈর্ঘ্য ১৮ ফুট, প্রস্থ সাড়ে ১২ ফুট। উচ্চতা আনু. ৩৫ ফুট। সামনের জগমোহনে তিনটি খিলান-রীতির দ্বারপথ। থামগুলি গোলাকার গুচ্ছ রীতির। বিমান বা গর্ভগৃহে একটিই দ্বার।
বিমান অংশে রথপগ বিন্যাস করা। এখানে সপ্তরথ বিভাজন। জগমোহনের গন্ডী অংশে গড়ানো চালা-ছাউনি। তাতে পীঢ়াশৈলীর থাক কাটা। দুটি সৌধেরই মাথায় শীর্ষক অংশে ক্রমান্বয়ে– বেঁকি, আমলক, কলস, বিষ্ণুচক্র।
বেশ কিছু টেরাকোটা ফলক দিয়ে অলংকরণের কাজ হয়েছে মন্দিরে। জগমোহনের তিন দিকের দেওয়ালে রয়েছে ফলকগুলি। কার্নিশের নীচ বরাবর এক সারি, দুটি কোণাচের দু’দিকে দুটি করে চারটি সারিতে, ছোট ছোট খোপে। সেখানে বিষ্ণুর দশাবতার, বলিরাজ-দমন, কদম্বতলে শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারানী, কুঠারধারী পরশুরাম, বংশীধারী একক কৃষ্ণমূর্তি, রাধা-কৃষ্ণ, জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম মূর্তি, বীণা-বাদক, সাহেবী পোষাকে রাজপুরুষ– ইত্যাদি মোটিফ দেখা যায়।
আরো কয়েকটি কাজের উল্লেখ করতে হয়– ১. একটি গরুড়-মূর্তি আছে গর্ভগৃহে। ২. গর্ভগৃহের দ্বারপথের দু’পাশে দুটি দ্বারপালিকা মূর্তি। ৩. ভিনিশীয় রীতির পাল্লা সহ একটি ‘প্রতিকৃতি দ্বারপথ’ রচিত হয়েছে পশ্চিমের দেওয়ালে। ৪. বিমানের দক্ষিণের দেওয়ালে বড় আকারের একটি প্যানেল। সেখানে গৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দের উদ্বাহু নৃত্যরত মূর্তি রচিত।
পঙ্খের ফুলকারী নকশাগুলিও তারিফ করবার মত। মাত্রই একশ’ বছর আয়ু এই মন্দিরের। কিন্তু জীর্ণতার গ্রাস শুরু হয়েছে মন্দিরের গায়ে।
সাক্ষাৎকার : শ্রী অমলেশ চোধুরী– মণিনাথপুর। শ্রী অমিতেশ চোধুরী– হবিবপুর, মেদিনীপুর।
যাওয়া-আসা : মেদিনীপুর-খড়্গপুর থেকে বেলদামুখী রাজপথের উপর মকরামপুর। আবার, বালিচক রেল স্টেশন থেকে দক্ষিণমুখে তেমাথানি। এই মকরামপুর এবং তেমাথানি সংযোগকারী পথের উপর মদনমোহন চক। সেখান থেকে সামান্য উত্তরে মণিনাথপুর গ্রাম এবং দেব চৌধুরী বাড়ির মন্দির।
প্রচ্ছদ -রামকৃষ্ণ দাস